ছট পুজো আসলে মা ষষ্ঠী এবং সূর্য দেবের পুজো

হেমন্ত মরসুম বদলের সময়। এ ভারি আশ্চর্য এক ঋতু। একদিকে শরতের জৌলুস ফুরিয়ে আসে। বদলে যায় বাতাসের গন্ধ। দিন ছোট হয়। দীর্ঘ হয় রাত। তাত নিভে যাওয়া বেলায় গাঢ় হয় ধানের গন্ধ। সেই অবসরে দেব বন্দনায় মাতে মানুষ। আহ্বান করে সূর্যকে। নতুন ধান্যে শস্যে আর সন্তানের সুখে ভরে উঠুক সংসার, রোগ, জরা থেকে মুক্তি আসুক তার প্রার্থনা চলে। দীপাবলি শেষ হলে ছট উৎসবে মেতে ওঠে দেশ।

পুরাণ মতে, ছট পুজো আসলে ছঠি মাইয়া অর্থাৎ মা ষষ্ঠী এবং সূর্য দেবের পুজো। শাস্ত্র মতে, ছঠি মাইয়া সূর্য দেবের বোন। তাই সূর্য দেবের আরাধনাও করা হয়। পরিবারে সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি বজায় রাখার উদ্দেশ্যে এই পুজো, যেখানে অস্তগামী সূর্যকে অর্ঘ্য দেওয়া হয়। এই উৎসবের সময়ে মহিলারা ৩৬ ঘণ্টা নির্জলা উপোস করে সন্তানের দীর্ঘায়ু কামনা করেন সূর্য দেব ও ছঠি মাইয়ার কাছে। ভক্তদের বিশ্বাস, এই পুজো নিষ্ঠাভরে করলে পরিবারে সুখ-শান্তি বজায় থাকে।

52cc458a-fbe3-4035-a98f-76eb5979f1f7

ছট পুজোর সঙ্গে যোগ রয়েছে মহাভারতেরও। পৌরাণিক মতে, কর্ণ ছিলেন সূর্যের পুত্র। সূর্য দেবের আশীর্বাদে তিনি ছিলেন অপার শক্তি ও ক্ষমতার অধিকারী। কর্ণ নিজে সূর্যভক্তও ছিলেন। তাই প্রত্যহ ঘণ্টার পর ঘণ্টা জলে দাঁড়িয়ে তাঁর উপাসনা করতেন।

দ্রৌপদীও ছিলেন সূর্যের ভক্ত। কথিত, জুয়া খেলায় পাণ্ডবেরা নিজেদের সর্বস্ব খোয়ালে রাজত্ব ফিরে পাওয়ার জন্য দ্রৌপদী সূর্য দেবের আরাধনা করেন। পালন করেন ছটের ব্রত। বলা হয়, দ্রৌপদী নিয়ম মেনে নিষ্ঠাভরে ছট উৎসব পালন করার পরেই পাণ্ডবেরা ফিরে পান তাঁদের রাজপ্রসাদ। তাই শাস্ত্রের সঙ্গে সঙ্গে ছট পুজোর উল্লেখ কিন্তু রয়েছে ভারতের মহাকাব্যেও।

চার দিন ধরে চলে ছট উৎসব। শিশুদের দীর্ঘায়ু, সুস্বাস্থ্য ও উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনায় এই উৎসবে উপবাস পালন করা হয়। হিন্দু ক্যালেন্ডার অনুসারে, ছট পূজা প্রতি বছর কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠ দিনে উদযাপিত হয়।

 এই ছট পুজোর আরও অনেক নাম রয়েছে, ‘ছটি’, ‘ছট পরব’, ‘ছট পূজা’, ‘ডালা ছট’, ‘ডালা পূজা’, ‘সূর্য ষষ্ঠী’। বলা যায় সূর্যকে ধন্যবাদজ্ঞাপনের উৎসব ছট পুজো, তাই সূর্য দেবতার কাছে মানত করেন ভক্তরা। সূর্য পুজোর এই উৎসবকে সূর্য ষষ্ঠীও বলা হয়।

ছট বা ছঠ, ষষ্ঠী নামের অপভ্রংশ। কার্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে দীপাবলি পালনের পর এই চার দিনের ব্রত শুরু হয় কার্তিক শুক্লা চতুর্থী থেকে আর চলে সপ্তমী অবধি। এই পুজোর সবচেয়ে কঠিন ও তাৎপর্যপূর্ণ রাত্রি হল কার্তিক শুক্লা ষষ্ঠী। বিক্রম সংবৎ-এর কার্তিক মাসের শুক্লা ষষ্ঠী তিথিতে এই ব্রত উদযাপিত হওয়ার কারণে এর নাম ছট রাখা হয়েছে।

e3927e64-8468-4cb9-81fd-a3ba57799b62

উৎসবের তিনদিন কঠোরভাবে উপোস করার বিধান রয়েছে। উপোসী মহিলা পঞ্চমীর দিনে মাত্র একবার নুন ছাড়া খাবার খান এবং ষষ্ঠীর দিন নির্জলা অর্থাৎ জল ছাড়াই থাকেন। ষষ্ঠীর দিন সূর্যকে পূজা করা হয় এবং অর্ঘ্য দেওয়া হয়। সারা রাত জেগে রেখে ভজন ও কীর্তন পরিবেশন করা হয় এবং পরের দিন অর্থাৎ সপ্তমীর দিন সকালে ভক্তরা নদী বা পুকুরে গিয়ে স্নান করে এবং আবার সূর্য উঠলে জল নিবেদন করে উপবাস সম্পন্ন করে।

চারদিনের এই ব্রতের প্রথম দিনে যিনি ব্রত পালন করবেন, তাঁকে বাড়িঘর পরিষ্কার করে স্নান সেরে শুদ্ধাচারে নিরামিষ ভোজন করতে হয়। পরদিন থেকে উপবাস শুরু। দিনভর নির্জলা থেকে উপবাস পালনের পর সন্ধ্যায় পুজোর শেষে ক্ষীরের ভোগ গ্রহণ করতে হয়। এই জন্য এই রীতির নাম খরনা।

তৃতীয় দিনে নিকটবর্তী নদী বা জলাশয়ের ঘাটে গিয়ে অন্যান্য ব্রতীদের সঙ্গে অস্তগামী সূর্যকে অর্ঘ্য অর্থাৎ দুধ অর্পণ করতে হবে। ব্রতের শেষ দিনে গঙ্গা ঘাটে গিয়ে উদীয়মান সূর্যকে পবিত্র চিত্তে অর্ঘ্যপ্রদানের পর উপবাসভঙ্গ করে  মিষ্টান্ন, ক্ষীর, ঠেকুয়া, নাড়ু এবং আখ, কলা, মিষ্টি লেবু প্রভৃতি ফল খেয়ে উপবাস ভঙ্গ করতে হয় ও পরিচিত সকলকে প্রসাদ বিতরণ করা হয়। 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...