‘কাঁইতাকূড়া’ দেবতার পুজোর পিছনে কি রহস্য আছে?

এখানে দেখা যায় গাধার পিঠে বসে দেবতা আর পাশে এক পাহারাদার রয়েছে, তিনি আবার ব্রিটিশ সিপাই। রাজা-রানিও আছেন। কোথায় দেখা গিয়েছে এই দেবতাকে?  

জলপাইগুড়ির ময়নাগুড়ির জরদা নদীর পাড়ে অপদেবতার উপদ্রব থেকে বাঁচতে কালীপুজোর পরদিন এই ‘কাঁইতাকূড়া’ দেবতার পুজো হল। রাজবংশী সমাজে ‘দেউসি’ নামে পরিচিত এক পুরোহিত পুরনো প্রথা মেনে এই পুজো দিলেন।

pUJO

জানা গিয়েছে, স্থানীয় মহলে নদী বক্ষে গভীর গর্ত রয়েছে। সেটা ‘কূড়া’ নামে পরিচিত। অন্যদিকে, ‘কাইতা’ অর্থাৎ কাত করা। দীর্ঘদিন ধরে জরদা নদী জুড়ে ছড়িয়ে থাকা কুড়াগুলো একেবারে এক একটা মরণ ফাঁদের মতন। একবার যদি আটকে গেলে তাহলে আর কোনও নিস্তার নেই, মৃত্যু অবধারিত।

প্রতিবছর জরদায় তিন থেকে চারজনের মৃত্যু হয় এইভাবে। ওই জন্য বিপদ এড়াতে সম্প্রতি প্রশাসনের তরফে সতর্কতা জারি করা হয়েছে। নদীতে ডুবুরি নেমেও দেহ উদ্ধার করে হিমশিম হয়ে যাচ্ছে। এমন ঘটনা ধিরে ধিরে ক্রমশ রহস্যে ঘনীভূত হয়ে পড়ছে।

তাই স্থানীয়দের কাছে এই জরদা নদী পরিচিত হয়েছে ‘মানুষ খেকো’ নদী নামে। অথচ শৈব তীর্থ জল্পেশ ছুঁয়ে যাওয়া কলোখাওয়া এবং বাগজান নামে দুই নদী মিলিত হয়ে তৈরি এই জরদা। পুরাণে পরিচিত পুণ্যতোয়া ‘জটোদ্ভা’ নামে। ওই পবিত্র নদী এখন ভয়ংকর হয়ে উঠতে অপদেবতার কারসাজির রকমারি গল্পে প্রচলিত হয়েছে। সেই সঙ্গে বিশেষ পুজোর আয়োজন করা হয়েছে এই বিপদ থেকে রক্ষা পেতে। কিন্তু গবেষকদের মতে এখানে ভূত-প্রেত অথবা অপদেবতার কোনও বিষয় নেই।  

ময়নাগুড়ি কলেজের ভূগোল বিভাগের প্রধান মধুসূদন কর্মকার এই বিষয়ে জানিয়েছে যে নদীতে ফানেল আকৃতির জলের ঘুর্ণিপাকের জন্যই সুরঙ্গের মতো গভীর গর্ত তৈরি হয়েছে। সেখানে জল পাক খায় আর গর্তের ভিতরে টানতে থাকে। ওই কারণেই একবার পাকে কেউ আটকে গেলে ক্রমশ গর্তে তলিয়ে যেতে থাকে। যতোই বড় সাতারু হোক তাও কিছু করার থাকে না। ঠিক দু’একদিন পর দেহ জলে ভেসে ওঠে।

কিন্তু গবেষকদের ব্যাখ্যা স্পষ্ট করলেও কে শুনছে? স্থানীয়দের মনে অপদেবতার ব্যাখ্যাই একেবারে জাঁকিয়ে বসেছে। 

স্থানীয় বাসিন্দা ৯৪ বছরের প্রবীণা সবিতা গুপ্ত জানিয়েছেন ‘অধুনা ময়নাগুড়ি শহরের গোবিন্দ নগর অর্থাৎ ১৭ নম্বর ওয়ার্ডে ওই পুজো ব্রিটিশ আমলে চালু হয়েছে। আদিতে ছিল খড়ের ছাউনি। রাজবংশীদের গ্রাম দেবতার থান। তার শ্বশুরমশাই ব্রজেন গুপ্ত ছিলেন বৃটিশদের সার্ভেয়ার। এখানে জমি জরিপ করতে এসে গ্রাম দেবতার থানটি দেখেছিলেন। পরে স্থানীয় জোতদার চেরুমোহন রায়ের পরিবারের এক দুর্ঘটনার পর গ্রাম দেবতার থান ‘কাঁইতাকূড়া’ মণ্ডপ হিসেবে পরিচিত হয়। পুজো মণ্ডপের পাশে জরদা নদী তিরতির করে বয়ে চলেছে।‘

স্থানীয় বাসিন্দাদের থেকে জানা যায় যে এখানেই জলের তলে রয়েছে কাত হয়ে থাকা গভীর কূড়া। যেখানে স্নান করতে নেমে মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। ওই এলাকা আশির দশকেও নদী সংলগ্ন গোবিন্দ নগরের বাঁশ, আম-কাঠাল বাগান ও ঝোপজঙ্গলে ভরা ছিল।

লোকসংস্কৃতি গবেষক দীনেশচন্দ্র রায়ের মতে, ‘এমন গা ছমছম করা পরিবেশ এবং পর পর মৃত্যুর ঘটনায় আতঙ্ক থেকে কল্পনায় অদ্ভুত দর্শনের দেবতার আবির্ভাব হয়ে থাকতে পারে।‘   

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...