শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মল চক্রবর্তীর পরিচালনায় ‘ দত্তা বাংলা সিনেমা

'জিয়ো আড্ডা উইথ অনিন্দিতা সরকার' শোয়ে আজ অতিথি টিম ‘দত্তা’  ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত,  জয় সেনগুপ্ত এবং জয় সরকার। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মল চক্রবর্তীর পরিচালনায় ‘দত্তা’ মুক্তি পেয়েছে প্রেক্ষাগৃহে। লকডাউনের আগে শুরু হয়েছিল ছবির শ্যুটিং। এসেছে মারীনিষেধের বাধা। সেই পর্ব কাটিয়ে কীভাবে তৈরি হল ছবি , সেই কাহিনি শুনুন তাঁদের মুখেই।

প্রঃ ঋতুদি’র কাছে আসি প্রথমে। ১৯৭৬ সালে সুচিত্রা সেনের ‘দত্তা’ আমরা দেখেছিলাম। আবারও একটা এতদিন বাদে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের এই উপন্যাসটি নিয়ে কাজ। এরকম একটা হয়ে যাওয়া কাজ আবারও তোমরা নতুন আঙ্গিকে আনছ। কোথাও কি চাপ অনুভব করেছ যে মানুষ কীভাবে ‘অ্যাক্সেপ্ট’করবে?

ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তঃ দ্যাখো, সাহিত্য যে কোনও সময় মানুষ ‘ক্রিয়েট’ করতে পারে। কিন্তু সাহিত্যের পাতা থেকে উঠে আসা চরিত্রগুলো মানুষ বারবার দেখতে চায় এবং তাই জন্যে সাহিত্য নিয়ে প্রচুর চর্চাও হয়েছে বহুকাল ধরে এবং তারা বারবার এরকম ধরনের কাজ আরও বেশি দেখতেও চেয়েছে। তো, সেখানেই দাঁড়িয়ে থেকে ৪৬ বছর পরে, আবার কাজটা হচ্ছে এবং আমি মনে করি যে এই সময় দাঁড়িয়ে থেকে আবারও হয়তো ভালোবাসবে দেখতে। কারণ, কোথাও গিয়ে দেবদাস আবার হয়েছে, পরিণীতা হয়েছে, ফেলুদা হচ্ছে, বহুবারবার চতুরঙ্গ হয়েছে। আমার মনে হয় যে কোথাও না কোথাও গিয়ে মানুষ বদলায়, ‘জেনেরেশন’ বদলায়। তখন তারা কিন্তু সাহিত্যের সঙ্গে সেই ‘টাচ’টা কথাও না কথাও অনুভব করে যে এখন তারা ফিরে আসুক নিজেদের সাহিত্যে। সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে ‘দত্তা’ আবার ভাবা হয়েছে। আর এখানে কোনও ‘কম্প্যারিসন’র ব্যাপার নেই। কারণ যেকোনো সময় একটা কাজকে আবার নতুন আলোতে দেখা যেতে পারে। সেইজন্য আমি মনে করিনা যে এখানে  কোনও ‘কম্প্যারিসন’-এর  জায়গা আছে। তবে, দর্শকের ভালো লাগার জায়গাটা তৈরি করাটাই হচ্ছে মূল উদ্দেশ্য, এবং আমরা যেহেতু সীমিত বাজেটে কাজ করি, আমাদের সেই ‘লিমিটেসন্স’ থাকে প্রচুর তাই জন্য কোনও জাঁক জমক কোনও সেট তৈরি করতে পারিনা, কোনও আলাদাভাবে ‘এক্সট্রা এফরট’ দিয়ে কোনোকিছুকে বলার চেষ্টা করিনি বা সাংঘাতিক কোনও ক্যামেরার ‘জাগ্লারি’-ও এই ছবিতে নেই। ‘ইটস আ সিম্পাল ন্যারেটিভ’।

যেভাবে গল্প বলা আছে আমাদের শরৎ বাবুর উপন্যাসে, সেইভাবেই আমরা চেষ্টা করেছি জিনিসটাকে ‘প্রেসেন্ট’ করতে আর কিছুটা কস্টিউমের ওপর  আমরা জোর   দিয়েছিলাম, যাতে ‘বেসিক কস্টিউম ড্রামা’ হয়। আমরা সবাই চেষ্টা করেছি ‘এফরট’ দেওয়ার। এখানে যারা বসে আছেন তারা প্রত্যেকে এত সহযোগিতা করেছে, জয় ‘অ্যন্ড’ জয় দুজনেই আমার প্রিয় বন্ধু এবং দুজনের সঙ্গেই অনেক কাজ করেছি। ফলে, সেই ‘কম্ফরট লেভেলটা’ ছিল এবং ভালো কাজ আমরা সবাই ইচ্ছে করে ঝাঁপিয়ে আমরা সবার সঙ্গে হাত ধরি। ঠিক সেইভাবেই এইটা তৈরি হয়েছে এবং আমি মনে করি যে ভীষণ বিরাট একটা প্রডাক্সান হউস না, তাহলেও আমরা আজ অব্দি যা ছবি করেছি, চেষ্টা করেছি আন্তরিক ভাবে ভালবেসে একটা কাজ করা। সেখানে এই ছবিটা আম্র মনে হয়েছে যে এটা ‘সিনেম্যাটিকালি’ আমরা খুব সুন্দর ভাবে ‘প্রেসেন্ট’ করতে পারি আর গানের ব্যাবহারটা অবশ্যই একটা বড় জায়গা তৈরি করেছে। কারণ দত্তা টা এমনি একটা ‘স্পেশাল’ উপন্যাস এবং সেখানে গানের জায়গাগুলো খুব স্পেশাল ভাবে আমরা তৈরি করা চেষ্টা করেছি যেখানে আমি করি রবীন্দ্রনাথ এবং শরৎ চন্দ্রের একটা দারুন মেলবন্ধন হয়েছে।

প্রঃ জয়দার কাছে আসব। এই ‘নরেন-এর ক্যারেক্টারটার জন্যে তুমি কীভাবে নিজেকে তৈরি করেছ?

জয় সেনগুপ্তঃ আমি সবসময় বলি যে একটা অভিনেতার পুরো জীবনটাই হল তার ‘প্রিপেরাসন্স’। তার দেখা্র চরিত্র, চার পাশের চরিত্রটা প্রিপেরেসন্স। সাহিত্য হচ্ছে সব থেকে বড়ো প্রিপেরাসন্স। এবং শরৎ চন্দ্রের মতন একজন রাইটার তিনি চরিত্র নির্ভর করে লিখতেন এবং সেই ক্যারেক্টার গুলো একটা সোশাল কন্ডিশনে এনে কীরমভাবে সেই ক্যারেক্টারটি রিঅ্যাক্ট করতেন। যদি সাহিত্যটাকে এপ্রিসিয়েট করা যায় চরিত্রটার গভীরে গিয়ে বোঝা যায় সেই সিচ্যুয়েশনটা, তাহলেই সেটা অভিনয়ে ইন্টারঅ্যাপ্ট  করে। শরৎ চন্দ্র একজন ক্লাসিকাল রাইটার এবং পপুলার। উনি সবার জন্যে লিখতেন। সবাইকে ভাবাবে। যে ভাবতে চাইবেন ভাববেন, যে এন্টারটেইন হবেন।

প্রঃ জয়দা, তুমি কীভাবে এগিয়েছিলে, মানে এখানে যে গানের নির্বাচনটা কীভাবে করেছিলে, বা রবীন্দ্র সংগীতটাকে ইন্সট্রুমেন্টালি নানা ভাবে সাজানো যায়, কীরকম ছিল সেই জার্নিটা?

জয় সরকারঃ এটা আসলে নির্মলদার ওয়ার্কটা এত ভালো ছিল,যে আমাকে বিশেষ কিছু ভাবতে হয়েছে সেটা নয় আর আমি সবসময় সিনেমার ক্ষেত্রে ডিরেক্টরকে ফলো করি। ডিরেক্টর কি চাইছেন সেটা আমি অন্ধভাবে ফলো করার চেষ্টা করি। ঋতু আমার বহুদিনের পুরনো বন্ধু। নির্মল দার সাথেও বহু পুরনো সম্পর্ক মানে মানুষটা খুব শান্ত এবং প্রচন্ড ভদ্র। আমি যখন নির্মল দার সাথে সিনেমাটা নিয়ে কথা বলতে শুরু করি, ওনার কাছে একটা পরিষ্কার আইডিয়া রয়েছে যেমন তিনি কি চাইছেন আর কি চাইছেন না। এটা জানাটা বেশী দরকার। তাহলে কাজ করাটা অনেক সুবিধে হয়ে যাবে। আমাদের তিনটে রবিন্দ্র সংগীত আছে আর একটা রজনীকান্তের গান।

আমাদের মনে হয়েছিল যে অই সময়টাকে ধরতে গেলে তৎকালীন বঙ্গীয় সময় এবং বাংলা ভাষা, এটাতে আমাদের ওই গানগুলোই আশ্রয় হওয়া উচিৎ এবং সেটা যতটা সম্ভব সময়টাকে বেশী ধরা যাবে। সময়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। সেক্ষেত্রে আমাদের মনে হয়েছে গান নির্বাচন জারা গেয়েছেন তাদের কথায় ভাবে। পুরোপুরি ইন্সট্রুমেন্টাল জায়গাটা। আমি যেমন অরিজিনাল ইন্সট্রুমেন্ট ইউজ করেছি, শরদ, সেতার, এস্ত্রাজ, বাঁশি ইউজ করেছি। এইজন্যই শুনতে রিচ লেগেছে এবং তখনকার সময়টাকে ধরা গেছে। আমি একটা জায়গা থেকে বাদ দিয়নি এবং সেটা নির্মল দা বলে দিয়েছেন এবং আর একটা যেটা ভালো লেগেছে, এখনকার অনেক সিনেমাটেই কাজ করতে গেলে দেখি যে প্রচুর আবহ সংগীত ব্যবহার হয়। নিশ্বাস নেওার জায়গা থাকে না কিন্তু নির্মল দা আমাকে বলেছিলেন যে কথা বলার জায়গাই তুমি কিছু কোরোনা, যেখানে স্পেস রয়েছে সেখানেই করো। সেইটা আমার মনে হয় ছবিটাকে একটা অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে।

প্রঃ শিল্পী নির্বাচনের ক্ষেত্রে তোমরা কিছু ভেবেছিলে?

জয় সরকারঃ এটা আমরা সবাই মিলে ভেবেছি, তার মধ্যে ঋতুর সবথেকে বেশী ইনপুট আছে। বাবুল যেই গানটা গেয়েছে, যেটা প্রথম রিলিজ হয়েছিল, সেটা যেমন জয়ের গলায় ভীষণ ভালো লেগেছে। এতটা উদাত্ত ভঙ্গীতে গেয়েছেন, বাবুলের গায়িকির সাথে প্রচণ্ড ম্যাচ করেছে। আবার আদিতি গুপ্তা গেয়েছেন ঋতুর গলায়। সেটা শুনে মনে হচ্ছে ঋতুই জেন গেয়েছে। সবার গলায় সবার গান শুনে মনে হয়েছে এর গলায় এই গানটা ম্যাচ করছে।

প্রঃ তোমরা দর্শকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে চাও?

ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তঃ আমি একটা বলতে চাই যে অনেক কষ্ট করে ছবি করি আমরা। তো, আপনারা যদি আসেন, ছবিটা দেখেন, ভালো ভালবাসেন, সেটাই আমাদের কাছে সবথেকে বড় প্রাপ্তি হবে। একটা সাহিত্য নির্ভর কাজ আমরা করতে চেয়েছি এবং আপনাদের সবসময় চাহিদা থাকে যে কেন সাহিত্যের কাজ হয়না বাংলায়। তো আমরা চেষ্টা করেছি, যে এই চেষ্টা যাতে সফল হোক। ১৬ই জুন মুক্তি পেয়ে গেছে আমাদের ছবি ‘দত্তা’, আপনারা দেখুন, প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে দেখুন এবং সফল করুন।

জয় সরকারঃ সত্যি বলতে, এই ছবিটা অনেকদিন ধৈর্য ধরে, পরিশ্রম করে সিনেমাটা বানিয়েছে। মাঝখানে বাঁধা এসেছে কোভিডের মতন সময় এসেছে। বছর চারেক লেগেছে আমাদের ছবিটা করতে। কতদিন কাজ বন্ধ ছিল। সেখান থেকে আজ ছবিটি মুক্তি পেয়েছে। আমাদের হৃদয়ের খুব কাছাকাছি একটা কাজের আমাদের সেরাটা দেওয়ার। আমাদের সফল তখনি সার্থক হবে যখন আপনারা এটি দেখবেন।

জয় সেনগুপ্তঃ যারা গল্প ভালবাসে তারা দেখবেন, যারা ছবি ভালবাসেন তাঁরা দেখবেন, যারা ঋতুকে ভালবাসেন তাঁরা দেখবেন।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...