পৃথিবী ঘুরে এসেও কলকাতা কেন পণ্ডিত বিক্রম ঘোষ-এর প্রাণের টান?

'জিয়ো আড্ডা উইথ অনিন্দিতা সরকার' শোয়ে আজ অতিথি সঙ্গীত নাটক আকাদেমি পুরস্কারে সম্মানিত শিল্পী পণ্ডিত বিক্রম ঘোষ। তাঁর সংগীত সংসারের সদস্য ‘দারাবুকা’ (Daraboukka) কেন এত প্রিয়? হাজার ত্যাগ স্বীকার করেও কেন তিনি ছাড়তে পারেন না কলকাতা? কেমন ছিল পণ্ডিত রবিশংকরের সঙ্গে যুগলবন্দির দিনগুলো? মন খোলা আড্ডায় শুনুন অজানা ‘বিক্রম’ কথা

প্রঃ তুমি এমন এক পরিবারের মানুষ যেখানে পুরোদস্তুর শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ঘরানার সাম্রাজ্য। সেই বাড়ির ছেলে, সেই শিক্ষায় মানুষ হয়েও তুমি ফিউশন মিউজিক, সিনেমায় মিউজিক কম্পোজ করছ- এই বৈচিত্র্য কীভাবে এসেছিল, অনুপ্রেরণা কোথা থেকে পেয়েছিলে?

পণ্ডিত বিক্রম ঘোষঃ আসলে একজন শিল্পীর জীবনে যা ঘটে সেটাই তার জীবন নির্ধারিত করে। তার ব্যক্তিগত জীবন কীভাবে চলে সেটার ওপরই অনেকটা নির্ভর করে। আমার জীবনে এত কন্ট্রাডিকশন ছিল ছোটবেলা থেকে যে এই কন্ট্রাডিকশনগুলো বোধগমাই করার জন্য যা আমার জীবনে করার সেগুলো করেছি। আমার জন্ম কলকাতায়। কিন্তু ৬ বছর পর্যন্ত বড় হওয়া ক্যালিফোর্নিয়ার সায়ন রাফেলে। ওই সময় ষাটের দশকের শেষ আর সত্তরের শুরুতে আমরা ফিরে আসি। তার প্রভাব ছিল। ফিরে এসে লা মার্টিনার্স-এর মতো স্কুলে ভর্তি হলাম আর বাড়িতে ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিকের মহল। আমাদের স্কুলে ক্ল্যাসিক্যাল গানবাজনার কোনও চল ছিল না। একজন-দুজন একটু আধটু করত। নব্বই শতাংশ পাশ্চাত্য মিউজিকে অভ্যস্ত। লা মার্টিনার্সে পাশ্চাত্য গান শেখানো হত। স্কুল থেকে মাঝে মাঝে আমি হেঁটে হেঁটে যেতাম পার্কসার্কাসের বালু হাকক লেনে। সেখানে মা সংযুক্তা ঘোষ গান শিখতেন মুনাওয়ার আলি খান সাহেবের কাছে। বড়ে গুলাম আলির ছেলে। যাঁর কাছে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, অজয় চক্রবর্তী গান শিখেছেন। আমার মাও শিখতেন। স্কুলে আমাদের একটা ব্যান্ড ছিল। আমি সেই ব্যান্ডে কঙ্গাস বাজাতাম। গান গাইতাম। বিটলস, রোলিংস্টোন এইসব ছিল। সেসব একদিকে চলছে আর আমি স্কুল ফিরত বালু হাকক লেনের বাড়িটায় যাচ্ছি। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে কানে আসছে গান। শুনতে পাচ্ছি কিনারে…কিনারে। আয়ে না বালম…

একেবারে বিপরীত আবহাওয়া। আবার বন্ধুদের মধ্যে যখন থাকছি সেখানেও জন্য জগৎ, হিন্দি সিনেমার গানও শুনছি। লুকিয়ে লুকিয়ট,পঞ্চমদা, মদনমোহন, কিশোরকুমার গিলছি। এইসবটা মিলিয়ে যে খিচুড়িটা পাকল তাতেই Became Bickram Ghosh.

পণ্ডিত রবিশংকরের সঙ্গে প্রায় ১ হাজার কনসার্ট, আলি আকবর খান সাহেব, আমজাদ আলি খান, সঙ্গে দক্ষিণী সঙ্গীত শিক্ষা। পণ্ডিত এস শেখরের কাছে তালিম। সেই সুবাদে বাল মুরলীজী, কাদরী গোপালনাথের মতো সাউথের শিল্পীর সঙ্গে বাজিয়েছি। এভাবে করতে করতে অনেক পরে ফিউশন মিউজিক ‘রিদমস্কেপ’ শুরু করলাম। সেটাও কুড়ি বছর হয়ে গেল। ফিল্ম কম্পোজ আরও পরে। 

প্রঃ তোমাকে তোমার গুণের জন্য গোটা পৃথিবী চেনে, কিন্তু তুমি কেন বাংলায় রয়ে গেলে?

পণ্ডিত বিক্রম ঘোষঃ একটা অদ্ভুত টান আছে আমার কলকাতার প্রতি। সেই টান শুধু টান নয়, Im at my creative best in Kolkata। এটা চিনেছি বেশ কিছু বছর আগে। আমি যেভাবে চলতে চাই সেটা এখানেই সম্ভব। একবার সত্যজিৎ রায়ের একটা ইন্টারভিউ শুনে মনে হল, ‘আমিও তো এভাবেই ভেবেছিলাম’। কলকাতায় আমার স্বাধীনতা আছে। নিজের স্টুডিয়ো, নিজের জাতগা। কেউ বিরক্ত করবে না। নিজের মতো অ্যালবাম বানাই। যাদের সঙ্গে কাজ করতে ভাল লাগে তাদের সঙ্গে কাজ করি। এটার জন্য আমায় অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। সঞ্জয় লীলা বনশালী তিনটে ছবির কাজ করতে চেয়েছিলেন। রাজকুমার হিরওয়ানীর মুন্নাভাই এমবিবিএস এমন ত্যাগ। কিন্তু আমি তার জন্য খুশি। আমি যে পরিমান কাজ করছি আর করব সেটা কলকাতায় না থাকলে হত না। আমি এখানে থেকে বারোটা হিন্দি সিনেমায় কাজ করেছি। এখনও পাশের ঘরে ‘ব্যান্ড অফ মহারাজা’র কাজ চলছে। আমাকে যারা সত্যি সত্যি চায় তারা এখানে চলে আসে। হরিজী, সোনুভাই, ডিরক্টর গিরিশ মল্লিক এমন অনেক নাম। একটা ইকো সিস্টেম হয়ে গিয়েছে এখন।

প্রঃ তোমাকে অভিনেতা বিক্রম ঘোষ হিসেবেও পেয়েছি, অভিনয়ের ভাবনা কীভাবে এলো?

পণ্ডিত বিক্রম ঘোষঃ  ওটা একটা ফেজ ছিল আমার। ২০০৩-০৪ সালে ‘হঠাৎ নীরা’ যখন করছিলাম তখন একটা সেলফ ডিসকভারি প্রসেস চলছিল নিজের ভিতর। তাছাড়া সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা গল্প, খুব অন্যরকম অদভুত একটা গল্পে, নিজের জীবনের সঙ্গে মিল পেয়েছিলাম। কসমিক সাইনস দেখতে শিখতে হয় মানুষকে। এই সিনেমাটা সেই মুহুর্তে মনে হয়েছিল আমার করা দরকার। সিনেমার সূত্রেই পরিচল হয়েছিল জয়ার সঙ্গে পরে বিয়ে। তারপর সিনেমার প্রস্তাব আসতে থাকে। এখনও আসে। খান তিরিশেক ছেড়েছি।

একটা ঘটনা ঘটেছিল যে কারণে আর সিনেমা করলাম না। আমার বাবা পণ্ডিত শঙ্কর ঘোষ। বাংলার প্রথম প্রজন্মের পেশাদার তবলাশিল্পী। আমি তার ছেলে। তবলা আমার জীবনের এক নম্বর জায়গায়। ‘হঠাৎ নীরার জন্য’ রিলিজের কিছুদিন পর একটা কনসার্টে বাজাতে গিয়েছি, হঠাৎ দেখছি ঘোষণা হচ্ছে, ‘ এখন আপনাদের সামনে বিখ্যাত অভিনেতা বিক্রম ঘোষ আসছেন তবলা সোলো বাজাতে’। শুনে আমি চমকে গিয়েছিলাম! আমার এত বছরের কাজ, এত ভাল ভাল কাজ একটা সিনেমার জন্য ধূলিসাৎ হয়ে গেল! এটাও একটা সাইন ভাবলাম। তাই আর সিনেমা করলাম না। এখন এক টা সিনেমার কাজ করছি। সেটা গিরিশ মল্লিকের ‘ব্যান্ড অফ মহারাজাস’। একটাই কারণে করেছি। এটা মিউজিক ফিল্ম। মিউজিক নিয়ে ছবি। আমিও মিউজিশিয়ানের ভূমিকায়।

প্রঃ বডি ড্রামিং-এর ভাবনা কীভাবে এলো?

পণ্ডিত বিক্রম ঘোষঃ ৯৩’তে আমি রবিশংকরজীর সঙ্গে প্রথম বাজাই। বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে কনসার্ট।প্রোগ্রাম শেষ হওয়ার পর ওখানকার কিছু বন্ধুবন্‌ধব বলল- ‘এত ভাল কনসার্ট হয়েচ্যহে, বারে যাওয়া যাক’। আমরা একটা বারে গেলাম। আমার পরনে তখন কনসার্টের পোশাক-পাঞ্জাবি পাজামা।  গিয়ে দেখলাম বেশ কয়েকজন মিউজিশিয়ান আছেন। তাদের মধ্যে এক কৃষ্ণাঙ্গ ড্রামার ছিলেন। আচমকা শুনলাম ঘোষণা হচ্ছে এখানে একজন বিখ্যাত ভারতীয় ড্রামার এসেছেন বিক্রম ঘোষ। ওই দলের সঙ্গে জ্যামিং-এর জন্য অনুরোধ করা হল। ওদের যা ইন্সট্রুমেন্টস ছিল সেগুলো দিয়েই বাজাতে শুরু করলাম। ফভাবলাম হইহই ফেলে দেব! সেই ড্রামার হঠাৎ দেখি বডি ড্রামিং শুরু করল। আমি চমকে গেলাম! যেন হেরে গেলাম  ওর কাছে! শেষ হলে দুজনে একসঙ্গে বসলাম। তখন ওকে জিজ্ঞাসা করলাম ‘তুমি আমকে ছোট্ট টিপস দেবে কীভাবে করছ”। ও একটা মজার কথা বলল। বলল, ‘টিপস দেব, কিন্তু তোমাকেও কিছু দিতে হবে’। আমি জানতে চাইলাম, ‘কী’। সেই ড্রামমার বলল, আমার শার্টটা তার চাই।

আমরা শার্ট অদল-বদল করলাম। ওর আফ্রিকান শার্ট আমি পরলাম আর আমার কুর্তাটা ওকে দিলাম। ও আমায় বেসিক টেকনিকটা শিখিয়ে দিল। অনেক বছর পর আমি সেটা ষোতে আনি। ২০০০ সালে। তার আগে করিনি। ভারতীয়করণ করেছি। ইন্ডিয়ান ইডিয়মে ফেলেছি। বডিড্রামিং করি ইন্ডিয়ান কনটেন্টে।

প্রঃ তুমি বাজার করো? কখনও করেছ?

পণ্ডিত বিক্রম ঘোষঃ ওই কখনও স্পেনসার্সে গেলে টুকুটাকি জিনিস কিনি, কিন্তু সবজি বাজার, মাছ বাজার করি না। 

প্রঃ তোমার রাগ হয়? সেটার বহিঃপ্রকাশ কেমন?

পণ্ডিত বিক্রম ঘোষঃ আমার রাগ বিখ্যাত ছিল। ইচ্ছে করেই পাস্ট টেনস’এ বলছি। গত আঠারো বছর ধরে সেই রাগ কমাবার চেষ্টা করছি। এখনও মোটামুটি ৭৫ শতাংশ সাকশেষফুল। আমি ১৮ বছর ধ্যান করছি। তার কারণ আমি উত্তেজিত হতে চাই না। রাগটা চয়েস। সে তোমায় রাগাল তার ক্ষতি হয় না, ক্ষতি হয় তোমার, শরীর-মনের ক্ষতি। মন খারাপ হল তোমার। রাগের পর সেটা নেমে গেলে একটা অনুতাপ হয়। আমার মতে রাগ বাজে ইনভেস্ট মেন্ট। আমি রাগটাকে এনে ফেলেছি!  

প্রঃ যারা গান-বাজনা নিয়ে জীবন এগোতে চাইছে তাদের কী মেসেজ দেবে?

পণ্ডিত বিক্রম ঘোষঃ একটা হচ্ছে ভীষণ ভাল শিক্ষা দরকার। ভাল করে না শিখলেও কেরিয়ার হয়েছে। কিশোরকুমার এসেছেন। আমার গুরু। কিন্তু তাঁদের সংখ্যা খুব কম তাঁরা ঈশ্বরের বর। ভালভাবে না রপ্ত করে এগোতে চাইলে শুরুতে নাম হতে পারে কিন্তু তার স্থায়ী হতে পারে না। শিখে করলে স্থায়িত্ব বেশি। আর দ্বিতীয় বিষয় রেওয়াজ। গান থেকে তবলা, সরোদ, সেতার যাই করো রেওয়াজ করতে হবে। এই দুই বিষয় ছাড়া আমি মনে করি না কেরিয়ার লম্বা আর ফলপ্রসূ হতে পারে বলে

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...