প্রভু জগন্নাথ মূর্তির অর্থ কী?

শ্রীক্ষেত্রের রত্নবেদিকায় মূর্তিরূপে আসীন প্রভু জগন্নাথ। জগন্নাথ দারুদেব। তিনি সব ইন্দ্রিয়যুক্ত হয়েও ইন্দ্রিয়হীন। ভক্তদের কাছে তাঁর গোলাকার দুই চক্ষু সূর্য আর চন্দ্র। তাঁর চোখে কোনও পল্লব নেই। তাই তিনি অপলক। নিদ্রাহীন দৃষ্টিতে জগৎকে সদাই দেখছেন। সমান্তরালভাবে প্রসারিত দুই বাহু। জগৎ সংসারের যা কিছু অতীতে ছিল, বর্তমানে আছে বা ভবিষ্যতে থাকবে-তা সবই তাঁর স্নেহে থাকবে। তাঁর হাত না থাকলেও তিনি সব কিছু গ্রহণ করছেন।

তাঁর পা না থাকায় তিনি স্থাণু, কিন্তু তিনি দূরগামী। কান নেই তবুও সবই শুনতে পান। তিনি সব কিছুই জানেন। তবু তাঁকে কেউ জানতে পারে না। তাই ব্রহ্মবিদদের কাছে তিনি মহান আর আদি পুরুষ। শ্রী জগন্নাথের বর্ণ কৃষ্ণ। তাঁর রঙে প্রকাশ পায় মহাবিশ্বের লৌকিক রূপ। গভীর রহস্যের আবরণে তিনি নিজেকে ঢেকে রেখেছেন-এই বর্ণ তারই প্রতীক।

কীভাবে তৈরি হয় জগন্নাথ মূর্তি

কথিত আছে দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার মূর্তি তৈরির কাজ হাতে নেন। পুরীর মন্দিরে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার মূর্তি কাঠের এবং এই মূর্তির হাত-পা নেই। জগন্নাথ দেবের যে বিগ্রহের পুজো করা হয়, তা কিন্তু অসম্পূর্ণ। কেন এই বিগ্রহ অসম্পূর্ণ তারও ব্যাখ্যা আছে।

মালবারের রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন জগন্নাথ মন্দিরের নির্মাণকালে স্বয়ং জগন্নাথের স্বপ্নাদেশ পান।

শ্রী দেব তাঁকে আদেশ দেন নীলাঞ্চল পর্বতের গুহা থেকে জগন্নাথের মূর্তি নিয়ে আসার। রাজার ঘনিষ্ঠ ব্রাহ্মণ বিদ্যাপতি জানতেন যে, সেখানে সবর জাতি অধিবাসীরা নীলমাধবের পূজার্চনা করেন এবং নীলাঞ্চল পর্বতের গুহায় নীলমাধবের মূর্তি লুকিয়ে রেখেছেন তাঁরা। সেই মূর্তির পুজো করতেন শবর জাতের দলপতি পুরোহিত ও নীলমাধবের পরম ভক্ত বিশ্ব বসু।

বিশ্ব বসুর কন্যার সঙ্গে বিদ্যাপতি বিয়ে করেন ও ছলনার দ্বারা নীলমাধবের মূর্তি সেই গুহা থেকে বের করে আনেন। এদিকে মূর্তি না-পেয়ে ভেঙে পড়েন নীলমাধব।

তার পর জগন্নাথ ফের রাজাকে স্বপ্নাদেশ দেন ও সেই মূর্তি পুনরায় নীলাঞ্চল পর্বতের গুহায় রেখে আসতে বলেন। পাশাপাশি রাজাকে প্রতিশ্রুতি দেন যে, তিনি ইন্দ্রদ্যুম্নের কাছে অবশ্যই ফিরে আসবেন।

এই ঘটনার পরই পুরীর জগন্নাথ মন্দির নির্মাণ করেন রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন। মন্দির নির্মাণ পূর্ণ হওয়ার পর রাজা জগন্নাথকে সেখানে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রার্থনা জানান।

রাজাকে জগন্নাথ স্বপ্নে দেখা দিয়ে বলেন যে, দ্বারকা নগরী থেকে পুরীর সমুদ্র তটে ভেসে নিমকাঠ দিয়েই যেন তাঁর মূর্তি তৈরি করা হয়। সত্যি সত্যিই পরের দিন পুরীর সমুদ্র সৈকতে একটি গুঁড়ি এসে ঠেকে। কিন্তু রাজার সৈন্যরা মিলেও সেই গুঁড়ি ডাঙায় তুলতে পারে না। এর পরই সবর জাতির দলপতি পুরোহিত বিশ্ব বসুর কাছে গুঁড়িটিকে ডাঙায় তোলার প্রার্থনা নিয়ে যান রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন। একা কাঁধে করে সেই নিম কাঠটি ডাঙায় তুলে আনেন বিশ্ব বসু।

কাঠ পাওয়া গেলেও মূর্তি তৈরি করবে কে? বিশ্বকর্মা এক বৃদ্ধ কারিগরের রূপ ধারণ করে ইন্দ্রদ্যুম্নের কাছে এসে হাজির হন। মূর্তি তৈরি করার জন্য তিনি তিনটি শর্ত দেন।

তিনি মূর্তি তৈরি করবেন একাই। ২১ দিনের মধ্যে মূর্তি তৈরি হবে। সেই ২১ দিন পূর্ণ সময় মন্দিরের  দরজা সর্বক্ষণ বন্ধ থাকবে।

বিশ্বকর্মার সব শর্ত মেনে নেন রাজা।

মন্দির গৃহের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। শুরু হয় জগন্নাথের বিগ্রহ তৈরির কাজ। কিন্তু বন্ধ দরজার ওপার কী হচ্ছে, কেমন হচ্ছে মূর্তি তৈরি- নিয়ে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের স্ত্রী গুন্ডিচা দেবীর আগ্রহ ক্রমশ বাড়তে থাকে। একদিন তিনি মন্দিরের দরজায় কান পাতলেন কিন্তু ভেতর থেকে কোনও শব্দ শুনতে পেলেন না।

তাঁর মনে হয়েছিল বৃদ্ধ কারিগর হয়তো ক্ষুধা-তৃষ্ণায় মারা গিয়েছে। খবর পেয়ে সেখানে পৌঁছন রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন। নিরুপায় হয়ে মন্দিরের দরজা খোলেন রাজা। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকে অদৃশ্য হয়ে যান বৃদ্ধ কারিগর রূপী বিশ্বকর্মা। জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রার তিনটি অসম্পূর্ণ মূর্তি দেখতে পান তিনি।

জগন্নাথের সেই অসমাপ্ত রূপই হয়ে ওঠেন প্রকৃত জগন্নাথ। 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...