কালিম্পং পাহাড়ে দুঃস্থ ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য প্রথম স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন স্কটল্যান্ডের গ্রাহাম সাহেব

পাহাড়ের ওপরে হলুদ রঙের বাড়ি। সারি সারি ঘর ছায়ার মত দাঁড়িয়ে রয়েছে। বিস্তৃত পাহাড়ি মাঠ জুড়ে খেলায় মত্ত ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা। আকাশি রঙের জামা ওদের গায়ে। সেই জামায় যেন পাহাড়ি আকাশ লেগে রয়েছে। পায়ে ফুটবল, চোখে-মুখে আনন্দের ঝিলিক। একটু পরেই বিকেল নামবে পাহাড়ে। কেউ কেউ ফিরে যাবে নিজের ছোট্ট আস্তানায়। কেউ আবার হলুদ রঙের বাড়িটার কোন একটা ঘরে বই-এর পাতা ওল্টাবে। ওদের দিন এভাবেই কাটে। পাহাড়ের আকাশ , সবুজ রঙের মাঠ ওদের সারাদিনের ক্লান্তি ভুলিয়ে দেয়।

IMG-20230722-WA0005

ইস্কুলটা ওদের কাছে আকাশের মত। যে আকাশ ওদের খুঁজে দিয়েছিল একজন ব্রিটিশ মানুষ। আজ থেকে প্রায় ১২৩ বছর আগে স্থাপিত হওয়া একটা স্কুল। গ্রাহাম হোমস স্কুল। তখন অবশ্য এই নাম ছিল না। সেন্ট অ্যানড্রিউজ কলোনিয়াল হোমস এই নামেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল একটি সংস্থা। প্রকৃত অর্থে দুস্থ ছেলেমেয়েদের আশ্রয় এবং তাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করার চেষ্টা করেছিলেন জন আন্ডারসন গ্রাহাম। ১৯০০ সালে তিনি এই প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলেন।

স্কটল্যান্ড-এর এই মানুষটি বেড়াতে এসেছিলেন কালিম্পং-এ। পাহাড়ের সৌন্দর্য যেমন উপভোগ করেছিলেন তেমনি পাহাড়ী মানুষদের কঠিন জীবনযাত্রা তাঁকে অন্তর থেকে ব্যথিত করেছিল। তবে মানুষের জন্য কাজ করার অনুপ্রেরণা তিনি পেয়েছিলেন যখন  তিনি নিজে এডিনবরায় কেরানি হিসেবে কাজ করতেন। তিনি একটি চার্চের এক ব্যক্তির কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে মানুষের জন্য কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

১৮৮৯ সালে তিনি একবার পাহাড়ে এসেছিলেন স্কটল্যান্ড থেকে। বেড়ানো এবং তার সঙ্গে কালিম্পং-এর একটি ছোট্ট গ্রামে চার্চের তরফ থেকে কিছু কাজ করা, এই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। সুন্দর প্রকৃতির মাঝে ওই অঞ্চলের মানুষ কত কষ্ট করে থাকে নিজের চোখে দেখেছিলেন এই জন আন্ডারসন গ্রাহাম।

IMG-20230722-WA0008

জীবন তাকে বদলে দেয়। কালিম্পং-এ    সমাজ সংস্কারক হিসেবে কাজ শুরু করেন তিনি। মূলত ব্রিটিশশাসিত ভারতবর্ষের পাহাড়ি, দুস্থ ছেলেমেয়েদের জন্য কাজ করেছিলেন। সেই সময় কালিম্পং-এর এমন অনেক ছেলেমেয়েরা ছিলেন যাঁদের বাবারা ছিলেন ব্রিটিশ কিন্তু মা ভারতীয়। কিন্তু তারা আর্থিক, সামাজিক দিক দিয়ে বেশ পিছিয়ে ছিলেন। এই ধরনের বাবা-মায়ের সন্তানরা সাধারণত রাস্তাঘাটে জীবন কাটাতেন। সংবাদমাধ্যম এবং প্রশাসনও এই বিষয়ে নির্লিপ্ত ছিলেন। জন অ্যান্ডারসন তখন এদের জন্য মূলত গড়ে তোলেন কলোনিয়াল  হোমস।

১৯০০ সালের ৭ ই সেপ্টেম্বর মাসে তিনি কালিম্পং-এর ডেলো পাহাড়ে একটি ঘর ভাড়া নিয়ে মোট ৬ জন নিপীড়িত ছেলে-মেয়েকে নিয়ে শুরু করেছিলেন তাঁর কাজ। তারপর ১০০ একর পাহাড়ি জমি কিনে তিনি একটি প্রশিক্ষণ স্কুল গড়ে তুলেছিলেন দুঃস্থ ছেলেমেয়েদের জন্য। পরবর্তীকালে এই স্কুলে যে কোনো পরিবারের দুঃস্থ ছেলেমেয়েদেরই জায়গা দেওয়া হত। থাকা-খাওয়া শিক্ষা-দীক্ষা সবকিছুর দায়িত্ব নিত স্কুল। ১৯০৬ সালে এই স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৮৭। ১৯২০ সালে সেন্ট অ্যানড্রিউজ কলোনিয়াল হোমসে প্রায় ৬০০ ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করতে আসেন। এদের স্বাস্থ্যের কথা খেয়াল রেখে ওই চত্বরেই এটি হাসপাতাল গড়ে তোলা হয়। ছেলেমেয়েদের স্বাস্থ্য ও শিক্ষা সব বিষয়েই খেয়াল রেখেছিলেন এই মানুষটি। পরবর্তীকালে জন আন্ডারসন গ্রাহামের নাম অনুসারে এই স্কুলের নাম হয় ডক্টর গ্রাহাম হোমস স্কুল। পাহাড়ের কঠিন জীবনযাত্রায় এই স্কুল আসলে আলোর দিশা। পাহাড়ের কঠিন জীবনযাত্রায় ছায়ার মতো আগলে রেখেছে আঁধারে থাকা মানুষগুলোকে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...