শিব-গৌরী, শিবের পাটা, নীল পাগল, চোতক্ষ্যাপা -চৈত্র সংক্রান্তির অনন্য উপাদান

চৈত্র মানেই চড়ক আর গাজন? না! বাংলার লোকায়ত দর্শনে চৈত্র মানে বঙ্গের নিজস্ব আচার রীতি উদযাপনের মাস। এই গোটা মাস কৃচ্ছ্রসাধনের, সন্ন্যাসের। বসন্তে বাংলায় শিবের আরাধনা হয়, গোটা চৈত্র মাসজুড়েই চলে শৈব আরাধনা। চৈত্রের শেষ পাঁচদিন নীল পুজো, বোলান গান, শিব গৌরির নাচের মাধ্যমে শিবকে তুষ্ট করা হয়। বাংলায় তিনি ভোলানাথ, ছাই মাখেন, স্ত্রীর মুখ ঝামটা শোনেন, সে'ভাবেই তিনি বঙ্গের লোক সংস্কৃতিতে মিশে গিয়েছেন। সাধারণ সংসারি মানুষও এই একটা মাস শিবের নামে সন্ন্যাস নেন, মধুকরি করে হবিষ্যান্ন গ্রহণ করেন। ভোলানামের নামেই তাঁদের এই কৃচ্ছ্রসাধন।

চোতক্ষ্যাপাদের ভিড় বাড়ে, আদতে তাঁরাও সন্ন্যাসী। অন্ত্যজ, প্রান্তিক শ্রমজীবি মানুষেরা নিছক মনের আনন্দে চৈত্রের গাজনে নাচানাচি করে, মধ্যাকথা গাজনে সামিল হয়। কেউ কেউ বোলান গানের দলে যুক্ত হয়। কারও কারও আবার নির্দিষ্ট কোনও দলও থাকে না। গ্রামে যে দল আসে তাতেই সামিল হয়ে যায়। কেউ কেউ মদ্যপান করেন, গাঁজায় দম দেন। মাথা কমিয়ে টিক্কিতে বিচিত্র বিচিত্র জিনিস বাঁধেন, রঙ মেখে সঙ সাজেন, মুখোশও পরেন কেউ কেউ। নানান অঙ্গ-ভঙ্গি করে নাচেন, উদ্ভট ছড়া কাটেন। এরাই চোতক্ষ্যাপা। এলাকার বিভিন্ন বাড়ি থেকে আবার চাল, ডাল, সবজি, টাকা ইত্যাদি সংগ্রহ করেন এরা। পারিশ্রমিক ভাবতে পারেন। ডোম, বাগদি, বাউরি সম্প্রদায়ের মানুষজন আবার মরার খুলি নিয়ে নাচতে নাচতে শিবের গাজন করে।

এছাড়াও চৈত্রে শিব গৌরীর নাচ থাকে, এক্কালে গ্রাম-গঞ্জে শিব-গৌরীর নাচ ছিল চৈত্রের মূল আকর্ষণ। আদতে বহুরূপী, শিব পার্বতী সেজে নাচতে বেরোতেন একদল লোক। চৈত্রের সন্ধ্যায় ফুর ফুরে হাওয়ার সঙ্গে হ্যাজাক বা হ্যারিকেন নিয়ে ঢাক ঢোল পিটিয়ে বেরোতো তাঁরা। বাড়ি বাড়ি গিয়ে নাচ দেখিয়ে পয়সা তুলত। সংস্কৃতির সঙ্গে সঙ্গে দিন যাপনের রসদ জোগাড়ও হয়ে যেত। কেবল রাতে নয়, দুপুর, বিকেলেও চলত এ জিনিস। অনেক জায়গায় আজও শিব পার্বতী সেজে গ্রামের রাস্তায়, বাড়ি বাড়ি ঘুরে নানাভাবে মনোরঞ্জন করে থাকেন বহুরূপীর দল। বাড়ি বাড়ি ঘুরে দান সংগ্রহ করেন এঁরা। চড়কের আগের দিন অর্থাৎ নীল ষষ্ঠীতে নীল চণ্ডিকার সঙ্গে নীলকণ্ঠ অর্থাত্‍ শিবের বিয়ে হয়েছিল বলে মনে করা হয়। সেই কারণে শিব পার্বতীর বিয়ের উত্‍সব হিসেবেও পালন করেন অনেকে। সে জন্যেই শিব গৌরীর নাচ চলে ঘুরে ঘুরে। দু’জন শিব এবং গৌরী সাজেন। মাঝে সাঝে কালী, লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ, অসুর এমনকী দুর্গার বাহন হিসেবে সিংহ সাজতেও দেখা যায়। শিবের ভক্তিমূলক গানের সঙ্গে চলে নাচগান। মেয়েদের পায়ে বাঁধা থাকে ঘুঙুর। সঙ্গে থাকে ঢোল-কাঁসর-সহ একদল বাদক। মেয়েরা গান ও বাজনার তালে তালে নাচে। স্থানীয় ভাষায় কেউ কেউ এদের ‘নীল পাগলের দল’ও বলেন।

চৈত্রসংক্রান্তিতে অর্থাৎ চৈত্র মাসের শেষ দিনে শিবের পুজো হয়। পাশাপাশি প্রায় সপ্তাহখানেক ধরে শিবের পাটা নিয়ে পুজো চলে। কেউ কেউ নীল পাটাও বলেন একে। নীলের দিন চড়ক গাছটিকে ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করা হয়, জলাশয় থেকে তোলা হয়। জলভরা একটি পাত্রে শিবের প্রতীক শিবলিঙ্গ বা সিঁদুর মাখানো লম্বা কাঠের তক্তা শিবের পাটা রাখা হয়, যা বুড়োশিব নামে পরিচিত। পাটা নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে মাগন তোলা হয়। নীল সন্ন্যাসী ও শিব-দুর্গার সঙরা নীলকে সাজিয়ে, বাদ্যি বাজিয়ে গান করতে করতে বাড়ি বাড়ি ঘোরান এবং ভিক্ষা সংগ্রহ করেন। নীলের গানকে বলা হয় অষ্টক গান।

আবার চৈত্র সংক্রান্তির দিনে পালিত হয় খেজুরভাঙ্গা উৎসব। বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিব-গৌরী নিত্যগীতি সহকারে মাগন তুলে, সারাদিন উপবাস পালন করেন ভক্তরা। চৈত্র সংক্রান্তির দিনে নারীরা একটি নিদিষ্ট খেজুরগাছের গোড়ায় দুধ এবং ডাবের জল ঢেলে পুজো করেন। পুজো শেষে সন্ন্যাসী দলনেতা গামছা গায়ে চড়িয়ে খেজুরগাছকে প্রণাম করে খালি গায়ে গাছে ওঠেন। এরপর সন্ন্যাসী দলের বাকিরা কাঁটাযুক্ত খেজুর পাতার উপরে দাঁড়িয়ে নাচে। গাছে ওঠা সন্ন্যাসী দলনেতা খেজুর গাছ থেকে খেজুর ভেঙে ভক্তদের মাঝে বিলাতে থাকেন। সেই খেজুর খেয়ে উপোস ভঙ্গ করেন ভক্তরা।

চড়ক পুজোয় শিব পাঁচালী পড়ার রীতি রয়েছে। পাঁচালী পড়া শুরু হলেই সন্ন্যাসীরা মহাদেবের নামে ধ্বনি দিতে দিতে নদীতে স্নান করতে যান। স্নানের পর মাটির কলসিতে করে জল ভরে আনেন তাঁরা। এরপর চড়ক গাছের গোড়ায় সমবেত হন সন্ন্যাসীরা। শিব পাঁচালী তখনও চলতে থাকে। এরপর ভক্ত ও সন্ন্যাসীরা চড়ক গাছে জল ঢেলে প্রণাম করে অন্য জায়গায় চলে যান। সেখানেই তাদের বাণবিদ্ধ করা হয়।

দেব। অনেক বাড়িতে কুমির পুজোর রেওয়াজও থাকে।

আদপে চৈত্রর শেষ কটা দিন সব কিছু জুড়েই কেবল শিবের উপস্থিতি। চড়ক গাছকে সারা বছর গ্রামের মধ্যে পুকুরে ডোবানো থাকে। গাজনের দিন গাছটিকে তুলে এনে পরিষ্কার করে মাটিতে স্থাপন করা হয়। গাছটিকে শিবের প্রতীক মনে করা হয় যেখানে ভূমি হল পার্বতীর প্রতীক। সে কারণে শিবের গাজন শিব আর পার্বতীর মিলনের উৎসব। কৃষকরা গাজন উৎসবকে নিজেদের জমির উর্বরতা বৃদ্ধির জন্যে পালন করেন। ধর্ম ঠাকুর নামে যে গাজন হয় তাও শিবেরই উৎসব, কারণ শিব ধর্ম ঠাকুর হয়েই লৌকিক বাংলায় সম্পৃক্ত হয়েছেন। যাবতীয় কৃচ্ছ্রসাধন, সবই শিবের নামে পুণ্যলাভের অভিপ্রায়ে। পুনর্জন্মের আশায়।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...