বাঙালির পিঠেই আজকের 'ফিউশন ফুড'-র আদিপুরুষ?

আজ মকর সংক্রান্তি, পৌষ পরবের দিন। এ যুগে শহরাঞ্চলে উৎসবটি অনেকটাই ম্লান, পাড়ায় পাড়ায় পিঠে-পুলি উৎসব আর মিষ্টির দোকানের কেনা পিঠে দিয়েই রসনা তৃপ্তি ঘটে ব্যস্ত বাঙালির। তবে গ্রামের ছবিটা এক্কেবারে আলাদা। বিশেষত রাঢ় বাংলায় পিঠে পরব দুগ্গা পুজোর মতোই কয়েকদিনের উৎসব। সংক্রান্তির আগের দিন তিলুরি সংক্রান্তি, আউন-বাউনি আরও কত কী! সব নিয়ম রীতি সরে গিয়ে পিঠেই বড় হয়ে গিয়েছে। আদপে পিঠে হল বাঙালির নিজের মিষ্টি। দেশ, পাড়া-গাঁয় কোথায় মিষ্টির দোকান আর কোথায় হরেক রকম মিষ্টি। বাড়ির ছোটদের চোখের খিদে পায় অর্থাৎ পেট ভর্তি থাকলেও ঘন ঘন মুখ চালাতে মন চায়। কিশোর-কিশোরীরা খেলে মাঠ থেকে খিদে নিয়ে ফেরে, ঘেমে-নেয়ে-তেতে আপিস করে বাড়ি ফেরা কর্তারও খিদে পায়, এক্কালে এ'সবের দাওয়াই ছিল মা-ঠাকুমাদের বানানো নাড়ু, পিঠে-পুলি। এমনকি অতিথি আপ্যায়নেও ছিল পিঠের উপস্থিতি।

গোটা গ্রাম জানান দিত পিঠে পরব আসছে। বাঁকুড়া-পুরুলিয়ার মানুষজন পাহার দেওয়া আরম্ভ করত। পাহার হচ্ছে ঢেঁকিতে ধান ভাঙার পদ্ধতির নাম। গ্রামের মানুষজন ওই নামেই চেনেন। অগ্রহায়ণ-পৌষ মাসে কৃষক ধান কাটার সঙ্গে সঙ্গে, ধান থেকে নতুন চাল ও চালের গুঁড়ো করার ধুম পড়ে যেত। সে'চাল দিয়ে পিঠে-পুলি, ফিরনি-পায়েস তৈরি করত পল্লীবাংলা। ঢেঁকির শব্দে মুখরিত হত বাংলা। পিঠের নাম ছিল পিষ্টক। চাল পিষে তৈরি হত বলেই হয়তো এমন নাম। পিঠের যে কত রকম ফের তা গুনে শেষ করার সাধ্যি নেই কিন্তু পিঠের রন্ধন শৈলীতে মিশে রয়েছে এক অদ্ভুত জিনিস। আজ 'ফিউশন ফুড' নিয়ে এত মাতামাতি কিন্তু বাংলার পিঠে তো সেই আবহমান কাল থেকে ফিউশনের সার্থক উদাহরণ। বাঙালির পাকশালা তো যেকোনও গবেষণাগারকেও প্রতিযোগিতায় ফেলে দিতে পারে। নয় কী! এই যে আজ এত কর্নফ্লাওয়ার, অ্যারারুটের বাড়বাড়ন্ত কিন্তু দিদিমা ঠাকুমারা তো সেই কবে থেকেই চাল গুঁড়ি মাখিয়ে শিউলি ফুলের পাতার বড়া, বক ফুল, কুমড়ো ফুলের খাইয়ে যাচ্ছেন। পিঠের ক্ষেত্রে ফিউশনের উদাহরণ ভুরি ভুরি।

চিড়ের পুলি, মুগের পুলির কথা ভাবুন। ফিউশন নয়? যে ডালকে ভিন দেশি বলে এসেছেন খাদ্য গবেষকরা; সেই ডাল দিয়ে খোল গড়ে ভিতরে নারকেলের পুর ঠেসে দিয়েছে বাংলা। চিড়ে মণ্ড পাকিয়ে তৈরি হয়ে পুলি। পাক-প্রণালীতে বিপ্রদাস দেখিয়েছেন কমলা লেবু, ডিম ইত্যাদি দিয়েও পিঠে তৈরি হত প্রাচীন বাংলায়। এ'সবই তো এ যুগের ভাষায় ফিউশন। আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়েছে ওপার বাংলা। সেখানে মাছ, মাংস দিয়ে পিঠে খাওয়ার রেওয়াজ। মাছে পুর ভরা পাটিসাপটা কিন্তু এই বঙ্গেও পাওয়া যায়। তবে এপার বাংলায় পিঠে দেবভোগ্য হিসেবে খাতির পায়। সে কারণেই মাংস, মাছ দিয়ে পিঠে-পুলির চল এখানে কম। পরমহংসদেব বলতেন, যা আছে ভুবনে তাই-ই তোর ভবনে। বাঙালির খাবারের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য। বহির্বঙ্গের এমন অনেক জিনিস নিয়ে মাতামাতি হয়, যার জন্ম আদপে বঙ্গদেশ।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...