কালী কথা: আখড়া কালী মন্দির

আখড়ার সঙ্গে জড়িয়ে থাকেন মহাবীর হনুমান। কিন্তু বাংলার এক আখড়ার সঙ্গে জড়িয়ে আছেন দেবী কালী। খিদিরপুরে অবস্থিত সেই কালী মন্দিরের নাম আখড়া কালীবাড়ি। কুস্তির আখড়া থেকেই আখড়া কালীর নামকরণ হয়েছে। মন্দিরের বয়স একশো বছরেরও বেশি। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এই আখড়া ও মন্দির। এই মাটিতে অরবিন্দ ঘোষ অর্থাৎ ঋষি অরবিন্দ, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর মতো ভারত মায়ের বীর সন্তানদের পা পড়েছিল। মন্দিরটি বছর তিনেক আগে নতুন করে তৈরি হলেও বিগ্রহ একই রয়েছে।

 

বাংলায় তখন স্বদেশি আন্দোলন মধ্যগগনে। অনুশীলন, যুগান্তের মতো বিপ্লবী সংগঠনগুলো গড়ে উঠেছে। সতীশ চন্দ্র বসু ও ব্যারিস্টার প্রমথনাথ মিত্রেরা অনুশীলন সমিতি গড়ে তুললেন। সমিতিতে তরুণদের লাঠি খেলা, শরীরচর্চা প্রশিক্ষণ দেওয়া হত। অনুশীলন সমিতির খিদিরপুর শাখার নাম ছিল খিদিরপুর দল। শাক্ত সাধক অনন্তশ্রী ব্রহ্মানন্দ সরস্বতী মহারাজের শিষ্য আশুতোষ ঘোষ ও প্রখ্যাত লাঠিয়াল পুলিন দাসের নেতৃত্বে এই খিদিরপুর দল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। মহাবীর হনুমানের মূর্তি সেখানে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে আখড়ার নাম হয় মহাবীর ব্যায়াম সমিতি। ১৯০০ সালে এই মহাবীর ব্যায়াম সমিতি নির্মিত হয়। যতীন্দ্র নাথ মুখোপাধ্যায় অর্থাৎ বাঘাযতীন, শ্যামসুন্দর সরকার, ননীলাল মুখোপাধ্যায়ের মতো বিপ্লবীরা ছিলেন এই আখড়ার সদস্য ছিলেন।

 

সেখানেই রয়েছে দেবী কালীর মন্দির। শাক্ত মন্দির। আজও এখানে বলিদান হয়। যুপকাষ্ঠ রয়েছে মন্দিরের সামনেই। পাশে একটি শিব মন্দিরও রয়েছে। মন্দির চত্বরে রয়েছে একটি কুঁয়ো। জনশ্রুতি অনুযায়ী, এর গঙ্গার যোগ রয়েছে। তাই এর বারিধারা কখনও শুকায় না। এই জল দিয়ে পুজোর যাবতীয় কাজকর্ম করা হয়। রয়েছে প্রকাণ্ড এক বট বৃক্ষ।

 

গর্ভগৃহে পাথরের বেদির উপর মা কালী বিরাজ করেন। বেদিতে থাকে ছটি নরমুণ্ড, তিনটি পুরুষের মুণ্ড, তিনটি নারীর। দেবী দক্ষিণা কালী। দেবী মূর্তি কালো কষ্টিপাথরে নির্মিত। মূর্তির উচ্চতা ফুট চারেক মতো। তিনি চতুর্ভুজা, দেবীর চার হাতের মধ্যে দুই হাতে থাকে খড়্গ, নরমুণ্ড  এবং অন্য দুই হাত অভয় ও বরাভয় মুদ্রায়। শাক্ত সাধক অনন্তশ্রী ব্রহ্মানন্দ সরস্বতী মহারাজের হাতেই দেবী এখানে প্রতিষ্ঠিত হন। পাশ দিয়ে বয়ে যেত গঙ্গা। হোগলা বনে দেবীকে প্রতিষ্ঠা করে পুজো করতেন অনন্তশ্রী ব্রহ্মানন্দ সরস্বতী মহারাজ। বাংলার ১৩১৯ সনের আষাঢ় মাসে তিনি দেহ রাখেন। তাঁর সমাধি মন্দিরও রয়েছে এখানে।

 

দুই বেলা দেবীর নিত্য পুজো হয়। দেবীর আরাধনা হয় তান্ত্রিক মতে। অমাবস্যা তিথিতে বিশেষ পুজো হয়। দেবীকে অন্নভোগ নিবেদন করা হয়। বলিদান হয়। কার্তিক মাসের দীপান্বিতা কালীপুজো হয় মহাসমারোহে। শ্যামাপুজো উপলক্ষ্যে সেজে ওঠে গোটা মন্দির। নানান উপাচারে দেবীকে ভোগ নিবেদন করা হয়। দূরদূরান্ত থেকে ভক্তরা আসেন মন্দিরে। বিপ্লবী, স্বাধীনতা সংগ্রামীরা কালী পুজো করতেন, বিপ্লবী সংগঠনকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এই কালী মন্দির সত্যিই ইতিহাসের অনন্য নজির।

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...