‘স্কুল খুললে বাচ্চাগুলোকে মাটির জিনিস বানানো শেখাব’

ঝুমা গঙ্গোপাধ্যায়

বাসুদেবপুর পল্লী হিতসাধনী হাইস্কুল

 

হাওয়া বয় না, দগদগে আগুন বাইরে, হাওয়া দূরদূরান্তে কোথাও কোনদিন কিনা মনে পড়ে না! কোনরকমে স্কুল যাতায়াত, খিদে নেই , শুধু জল আর জল! ধুঁকতে ধুঁকতে যেন চলছে মানুষগুলো, পিঁপড়ের মতো! ধুঁকছে তাও ছুটছে। এও কী জীবন!শুধুই বন্ বন্! যা হোক, তাহোক একহপ্তার একটা সরকারি নির্দেশ এতো, ছুটি! ওরে বাপরে, ছুটি তো পাওয়া গেল, কিন্তু গরম থেকে ছুটি নেই! ভর গরমে ঘরে বসে আছি, এসি নেই, কষ্ট পাচ্ছি, ভাবছি এসি কিনব এরপর টাকাপয়সা হলে, আমরা কাহিল কিন্তু স্কুলের বাচ্চাগুলো কিন্তু কাহিল হয় না, স্কুল বন্ধ হলে হাজারো সমস্যা, খেতে পায় না, মা সক্কাল বেলা বেরিয়ে পড়ে, বাবা মাছ বেচতে যায়, আসে বেলা একটা, মা আসার আগে রান্না করতে হয়, হাবিজাকে, মাত্র এগারো সে! স্কুলে এসে এই ভর দুপুরে, গরমে প্যাচপ্যাচ ঘেমে মাঠে দৌড়াদৌড়ি করে, মুসলমান বাড়ির মেয়ে, দাদা বাইরে বেরলে খুব মারে! স্কুল তার বড়ো প্রিয়। রোহিত মোল্লাটার তো এক দিদি রান্না করে বাড়ি ফেরে, তবে খেতে পায়, তার ঘর জোড়া অন্ধকার।একটা হলুদ আলো জ্বালতেই দেখেছিলাম, এক উঁচু চৌকির তলায় তক্তা পেতে অন্য বিছানা। ডানপাশ বামপাশ জুড়েই তক্তা পাতা। রাতে সবাই পরপর ঢেলে ঘুমায়, ওদের গরম লাগে না হয়ত আমাদের মতো! ঘরের বাইরে ড্রেনের ওপর টিনের চালাটা বাড়িয়ে রান্নাঘর বানানো! রাস্তার ঢালাই করা স্ল্যাব চুরি করে পাতা। যতো গণ্ডগোল আমাদেরই!

হঠাৎ ছুটি তাই, অনেকেরই ফোন, স্কুল কি ছুটি ম্যাডাম?

হ্যাঁ রে বাবু,

পড়তে বসছিস?

হ্যাঁ ম্যাম,

ওরা পড়বে না জানতাম। ওদের আমরা ক্লাসে বসেই পড়া মুখস্থ করাই! যেটুকু শেখাই ছুটিতে তাও কালের গর্ভে চলে যায় ‌।

অভিজিতের বাবা নেই। মা কোনরকমে কাজ করে চালায়, বাংলাদেশের এক ছেলেকে বিয়ে করল, তারপর এক ছেলে, এক মেয়ে। মেয়ে বাপের সঙ্গে বাংলাদেশে, ছেলে রাস্তায় রাস্তায় ঘোরে, একদিন ধরে এনে ভর্তি করেছিলাম। খাবার লোভে স্কুলে আসে! তিন পিরিয়ড থেকেই উঁকিঝুঁকি মারে, রান্না হলো কিনা দ্যাখে! আরে ছেলেটা খাবে কী! কেন যে মোহ বাড়ছে ওদের জন্য জানি না! বয়সের সঙ্গে সঙ্গেই যেন ওদের সাথে মিশে থাকতে পারি, ওদের খেলা, মারপিট, শয়তানি সব কিছুর মধ্যে নিজেকে যেন ফিরে পাই!কাত হয়ে শুয়ে শুয়ে কত কী ভাবি একদিন আর স্কুলে যেতে হবে না, তার পরদিন থেকে ওদের দেখতে পাবো না! কত কি অনাবিষ্কৃত থেকেই যাবে.. হঠাৎ দেখলাম রাস্তা দিয়ে গ্যাসওয়ালা ভ্যানগাড়ি যাচ্ছে, আর সাইফুদ্দিন পেছনে পা ঝুলিয়ে বসে আছে, আমি চিৎকার করে উঠি,

কিরে, সাইফুদ্দিন স্কুল যাবি না?

সাইফুদ্দিন হাসে, বলে, ঘুম থেকে ডেকে দেবার কেউ নেই!

কেন রে মা কোথায়?

মা, কোন সকালে চলে যায়, আমার ঘড়ি নেই, মোবাইল নেই, উঠতি পারি না।

সাইফুদ্দিন চলে যাচ্ছে, আমি চিৎকার করছি! আমার ঘুম ভেঙে গেল, নাহ্ এই ছেলেপিলেগুলো আমায় স্বপ্নেও মেরে ফেলবে!

ভাবলাম ওদের নিয়ে একটা বাগান করব! মাঠটা পরিস্কার করবো। পাতা পড়ে স্তূপ হয়ে আছে! লেবু গাছ, লঙ্কা গাছ, কিছু ফুল গাছের চারা সব বলে রেখেছিলাম। একটানা ছুটি মোটেও পছন্দ নয় আমার, তবু রব শুনতে হয়, আমাদের অনেক ছুটি! চারিদিকে ফোন করে জানতে পারলাম, একটা সংস্থা আছে, কিছু অনাথ বাচ্চাকে পড়াতে হবে! নাহ্ আর দেরি না করে বেরিয়ে পড়লাম, গঙ্গার ধারে একটা অনাথ আশ্রমে গেলাম, কিছু চকলেট নিলাম! ওরা সেরম কিছু জানে না এটা স্বাভাবিক, তবু মেঝেতে পা ছড়িয়ে ওদের পাশেই বসে পড়লাম। কতক্ষণ ছিলাম মনে নেই, সন্ধ্যে নেমে এল, বলে এসেছি, কাল মাটির পুতুল, খেলনা, ফল বানাবো সবাই,  প্রচুর গঙ্গামাটি! খুব আনন্দ লাগছে, ভেতরটা ফুরফুরে লাগছে! নাহ্ সব মাটি হয়ে যায়নি এ ছুটিতে!

এবার ছুটি খুললে বাচ্চাগুলোকে মাটির জিনিস বানানো শেখাবো, মনে মনে বিড়বিড় করে উঠলাম!

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...