গরমকাল মানে আমাদের কাছে চার আনার তেঁতুল মাখা!

সোমশ্রী অধিকারী, ব্যারাকপুর

 

এসো হে বৈশাখ এসো এসো...

 

আমার ছোটবেলা কেটেছে ব্যারাকপুরের মণিরামপুরে। আমাদের শহরে বিখ্যাত ছিল রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি যেটা এখন মহাদেবানন্দ কলেজের একটি শাখা নামে পরিচিত এবং সিপাহী বিদ্রোহের নায়ক মঙ্গল পান্ডে প্রথম এই ব্যারাকপুর সেনানিবাস থেকেই সিপাহী বিদ্রোহের সূচনা করেছিলেন।

গরমকাল মানে আমাদের কাছে ছিল চার আনার তেঁতুল মাখা, লাল কালো 'চুরোণ',  আট আনার নারকেল আইসক্রিম, কুলপি....আরও কত কিছু।

 

summ-1

গরমকাল মানে আমাদের কাছে ছিল দেদার মজা।অপেক্ষা করে থাকতাম কবে গ্রীষ্মের ছুটি পড়বে। ছুটির দুপুরে বন্ধুরা মিলে পাশের বাড়ির কত পেয়ারা, আমলকী আর আচার চুরি করে খেয়েছি তার হিসেব নেই।

গরমের ছুটিতে মামার বাড়ি বেড়াতে যাওয়ার মজাই ছিল আলাদা। হ্যারিকেনের আলোয় দিদার কাছে গল্প শোনার আশায় বসে থাকতাম, আর গা ছমছমে  ভূতের গল্পে শিউরে উঠতাম ।

আরেকটা কারণে গরমকাল ছিল আমাদের কাছে মহার্ঘ্য ।

ভোরবেলায় উঠে আমরা সব বন্ধুরা মিলে মর্নিংওয়াকে বের হতাম। রিভারসাইড রোডটা সেনাবাহিনী কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত যার ফলে রাস্তাঘাট ঝকঝক করত সব সময়।

মর্নিংওয়াকে বেরিয়ে তেঁতুল, কাঁচা আম আর ফুল কুড়িয়ে নিয়ে বাড়ি ঢুকতাম আর যদি আগের দিন রাত্রে ঝড়-বৃষ্টি হতো তাহলে আম-তেঁতুলের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যেত।

summ-2

বাবার আদেশ ছিল সকাল ৭ টার মধ্যেই পড়তে বসতে হবে সুতরাং আমরা ভোর চারটের সময় বেরিয়ে ৬ টায় বাড়ি ঢুকতাম। বাড়ি ফিরে যেতাম গঙ্গায় স্নান করতে। একরাশ আনন্দ করে বাড়ি ফিরতাম....কখনও বিকেলে ঠাকুমা, কাকীমা,  পিসীর সঙ্গে গঙ্গার পাড়ে বেড়াতে যেতাম।

মুন্নিদির বাবা কি অনায়াসে বেলুনের মধ্যে গ্যাস ভরে সাপ বানিয়ে 'কামড়াবে না, কামড়াবে না' বলে বিক্রি করত ।

কতবার সেই গ্যাস বেলুন হাত থেকে উড়ে গেছে আর বোকার মত আকাশের দিকে তাকিয়ে চোখের জল ফেলেছি...

সেসব আজ স্মৃতি।

আমি সেই  মানুষদের মধ্যে একজন যারা ছোটবেলায় হ্যারিকেনের হলুদ আলোয় পড়াশোনা করেছি। আর যদি কখনও সন্ধের দিকে ঝড় উঠত তো, আমাদের আনন্দ দেখে কে!

অন্ধকারে পাশের  বাড়ির  টুপটাপ আম পড়ার শব্দ শুনতাম আর ভাবতাম কখন সকাল হবে। কখনও ঝড়ের সঙ্গে আচমকা আসত শিলাবৃষ্টি।

সেই শিল কুড়িয়ে খাওয়ার আনন্দ মার খাওয়ার দুঃখকে ভুলিয়ে দিত। যেহেতু তখন ইলেকট্রিক ছিল না, হাতপাখা দিয়ে হাওয়া খেতেই আমরা বেশি অভ্যস্ত ছিলাম। ঠাকুমা পাখার ধার দিয়ে লেস লাগিয়ে তার সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিত। ছিল শীতলপাটি...আর ছিল মাটির কুঁজো যার ঠান্ডা জল ফ্রিজের জলের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে।

সে সব দিনে সন্ধ্যেবেলা কোথাও কোন বাড়িতে অনুষ্ঠান হলে জেনারেটর ভাড়া করা হত। ওই জেনারেটরের আলোর কী যে টান! কেমন যেন সাজ সাজ ব্যাপার একটা! আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকতাম তার জন্য।

গ্রীষ্মকাল প্রিয় ছিল আরও একটা কারণে। মনে পড়ে টিভিতে তখন 'ছুটি ছুটি' নামে একটা অনুষ্ঠান চলত। তখন আমাদের ইলেকট্রিকের সঙ্গে টিভিও এসে গেছে। সাদাকালো ছবিগুলোই সে সময় টিভিতে বেশি দেখানো হত এবং গোগ্রাসে গিলতাম পথের পাঁচালী ,  হিরে মানিক, কাবুলিওয়ালা ইত্যাদি সব অবিস্মরনীয় ছবি যেগুলো এখনো মনের মনিকোঠায় সযত্নে রাখা আছে।

মনে পড়ে, এক দইওয়ালা কাকুর কথা। আমরা অমলের মত তার অপেক্ষায় থাকতাম গরমের দিনে। তবে সেই দইওয়ালা বাঁকে করে তার দই নিয়ে আসত না, আসত সাইকেলের ঘন্টি বাজিয়ে। আওয়াজ শুনেই ছুটে যেতাম। কাকু বহু সযত্নে পোয়া মেপে বাটিতে দই তুলে দিত। দুপুরে সেই দই ভাত দিয়ে খাওয়ার নিয়ম ছিল; সঙ্গে থাকত গাছ থেকে পাড়া গন্ধরাজ লেবু অথবা লেবু পাতা। রবিবার বসে থাকতাম কখন মা টক দই দিয়ে ঘোল বানাবে।

summ-4

গরমকাল এলে আজও মনে পড়ে গাজন আর চড়কের মেলা। আমাদের সময় আপন-পরের তফাৎ ছিল না।

মেলায় ঘোরার জন্য পাশের বাড়ির কাকু, কাকীমা, দাদু, দিদা সবাই আমাদের টাকা দিত। নাগরদোলা, রঙিন কাগজ দিয়ে তৈরী ঘূর্ণি, তালপাতার বাঁশি, কাঁচের চুড়ির রিনরিন শব্দে রঙিন হয়ে উঠত আমাদের মেলা।

চড়কের মেলা আজও হয় কিন্তু সেই আন্তরিকতার দিন শেষ হয়ে গেছে কবেই।

ছিল পয়লা বৈশাখ - নতুন জামা, মিষ্টির প্যাকেট আর রসনা দিয়ে তৈরী সরবত। তখন অন্য ঠান্ডা পানীয়'র এত রমরমা ছিল না।

summ-3

এখনকার বাচ্চারা আমাদের সেই আনন্দ খুব একটা বুঝবে না। কত ছোট ছোট বিষয়ে আমরা আনন্দ খুঁজে নিতাম। বন্ধুদের মধ্যে ঝগড়া হত প্রচুর কিন্তু 'ডিপ্রেশন' কী জানতাম না। এখনকার শিশুদের জীবনযাত্রা আমাদের থেকে অনেক বেশি উন্নত, কিন্তু প্রযুক্তিবিহীন আমাদের ছোটবেলায় এই সামান্য আনন্দগুলোই ছিল জীবনের অনেক বড় পাওয়া। সে সব পাওয়া এখনও যে কোন কঠিন পরিস্থিতির সামনে দাঁড়াতে মানসিক শক্তি যোগায়।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...