শ্রীরামপুরের বল্লভপুর এলাকায় কিভাবে শুরু হল রাধাবল্লভ ঠাকুরের পুজো?

শ্রীরামপুর মানেই ইতিহাস। ঐতিহ্য মোড়া এক শহর। প্রতিটি প্রান্তেই ছড়িয়ে রয়েছে বহু জানা অজানা ইতিহাস।

আজকে জেনে নেওয়া যাক শ্রীরামপুরের দর্শনীয় এক মন্দিরের কথা, যা শ্রীরামপুর ইতিহাসের সাক্ষী।

শ্রীরামপুরের বল্লভপুরের ঠাকুরবাটি স্ট্রিটে অবস্থিত রাধাবল্লভ জীউর মন্দির।

১৭৬৪ ক্রিস্টাব্দে রাধাবল্লভের নতুন মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন কলকাতার পাথুরিয়াঘাটার নয়ান চাঁদ মল্লিক। এরপর ১৮৩৭ ক্রিস্টাব্দে তাঁর পুত্র নিমাই চরণ মল্লিক এই বিগ্রহের নিত্য সেবার চিরস্থায়ী ব্যবস্থা করেন।  

এই মন্দিরটি বাংলার সবচেয়ে বৃহত্তর আটচলার মন্দিরগুলোর মধ্যে অন্যতম।

আজকের রাধাবল্লভ মন্দিরের ইতিহাস খানিক অন্যরকম।

জানা যায়, প্রাচীন রাধাবল্লভকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রুদ্ররাম পন্ডিত। চাপড়ার বিখ্যাত দোল মঞ্চের আদলে তৈরী হয়েছিল রাধাবল্লভ জিউর দোল মঞ্চ।

বর্তমানে এই মন্দিরের সভাপতি এই মন্দির নিয়ে জানিয়েছেন যে এই প্রাচীন মন্দিরের প্রতিষ্ঠাটা হলেন রুদ্ররাম পন্ডিত। তাঁর বাড়ি ছিল যশোরে এবং মামার বাড়ি ছিল শ্রীরামপুর চাতরা দোলতলায়। তিনি প্রথমে শাক্ত বংশের লোক ছিলেন কিন্তু উনি কৃষ্ণের ভক্ত ছিলেন।

একদিন মামার বাড়িতে এসেছিলেন। তাঁকে তাঁর মামা বলেছিলেন নারায়ণ সেবা না করতে তিনি (মামা) গঙ্গাস্নান সেরে নারায়ণ সেবা করবেন। কিন্তু, মামা নারায়ণ সেবা করতে গিয়ে দেখে যে রুদ্ররাম আগেই সেবা দিয়ে দিয়েছিলেন। তখন তাঁর মামা রেগে গিয়ে খরম পেটা করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেন।

সেই সময় এই চত্বরের নাম ছিল আখনা গ্রাম। এখানে এসে তিনি গঙ্গার ঘাটে বসে তপস্যা করেন এবং শ্রী কৃষ্ণের দর্শন পান। সেখানে কৃষ্ণ তাঁকে বলে যে ‘নবাবের সিংহ দরজায় একটা পাথর ঘামছে সেই পাথর মহামন্ত্রীর কাছে আছে সেই পাথরটা তুমি নিয়ে এসো এবং সেই পাথর থেকে তিনটে কৃষ্ণ মূর্তি তৈরি হবে’।

কিন্তু নবাবের মহামন্ত্রীর কাছে কিভাবে গেল সেই পাথর? মন্দিরের সভাপতি জানিয়েছেন যে একদিন নবাব সেই দরজা দিয়ে যাওয়ার সময় তাঁড় মাথায় ওই পাথরের ঘাম পড়েছিল। তখন মহামন্ত্রী ছিল হিন্দু। তিনি নবাবকে জানান যে হিন্দু ধর্মে পাথর ঘামলে অশুভ। নবাব শুনে সরিয়ে দিতে বলে সেই পাথর। তখন মহামন্ত্রী পাথরটাকে নিয়ে নেন এবং নিজের বাড়িতে রাখেন। পরবর্তীকালে তিনি স্বপ্নদেশ পান যে ‘একজন পন্ডিত আসবেন এবং এই পাথর নিয়ে যাবেন’।

এরপর রুদ্ররাম পন্ডিত গিয়ে পাথর নিয়ে তিনটে ঠাকুর তৈরী করেন। এক হচ্ছে শ্রীরামপুরের রাধাবল্লভ, খড়দহর শ্যামসুন্দর আর সাঁইবোনের নন্দদুলাল।

সভাপতি আরও বলেন যে প্রথমে শ্যামসুন্দর কে দিতে চাননি রুদ্ররাম। বীরভদ্র এসে অনেক আকুতি মিনতি করতে তারপরেই দিয়েছিলেন।

নয়ান চাঁদ শ্রীরামপুরের রাধাবল্লভ ঠাকুরের মন্দির গড়া নিয়ে স্বপ্নদেশ পান। এরপর মাঘী পূর্ণিমার দিন প্রতিস্থিথয় এই ৪৩৯ বছর প্রাচীন মন্দিরটি।

এই মন্দিরে সেবা করার প্রচুর লোকজন রয়েছে এবং সবার আলাদা আলাদা দায়িত্ব রয়েছে সেই অনুযায়ী কাজ করা হয়।

জানা গিয়েছে এই মন্দিরে ভগবানের নিত্য সেবার আয়োজনও হয়ে বিরাট করে।

মন্দির ঘিরে এই পরিবারের কন্যা সোমা চক্রবর্তী জানিয়েছেন যে তাঁর বাবার নাম শৈলেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। তাঁর বাবা হচ্ছেন এই রাধাবল্লভ মন্দিরের সেবায়েত ছিলেন। ১৯৮২ সালে প্রয়াত হন তাঁর বাবা। তিনি জানান যে যখন ঠাকুরের গোষ্ঠ হত তখন তাঁর বাবা সহ আরও সেবায়েত মিলেই রুপোর সিংহাসনকে ব্রাসো দিয়ে পরিষ্কার করে কাঁধে করে পাড়ায় পাড়ায় নিতে যেতেন।

পরবর্তীকালে, তাঁর বাবা মারা যাওয়ার পর তিনি ও তাঁর মা দুজনে মিলে ঠাকুরের সমস্ত রকমের পালা কিংবা অনুষ্ঠান যা হয়, সেখানে অংশগ্রহণ করেন।

সোমা চক্রবর্তী জানান যে তিনি থাকেন মহেশতলার বাটানগরে কিন্তু প্রতিবছর তিনি ছোটবেলা থেকে পুজো করে আসছেন এই ঠাকুরকে। যখন গোষ্ঠর পুজো হত তখন পাড়ার সবাই সামর্থ অনুযায়ী খাবার পরিবেশন করতেন এবং ঠাকুর প্রত্যেক বাড়ি বাড়ি গিয়ে খেতেন। দেখা যায় একটা সময় সেটা বাড়তে বাড়তে জিটি রোড পর্যন্ত পৌঁছে যায়। তবে, বর্তমানে অনেক অসুবিধের কারণে এখন মন্দিরেই এই কাজ গুলো করা হয়।

এখানে বড় তাম্রপাত্রের মধ্যে পঞ্চগব্য দিয়ে ঠাকুরের স্নান করা হয়। তাঁর কথায় একেবারে বাচ্চা ছেলের মতন করেই আদর যত্ন করা হয়।

এই মন্দিরে জলপানের ব্যবস্থা আছে। সকাল ৯টা থেকে ৯.৩০ করে জলপানের ব্যবস্থা রাখা হয়। এরপর দুপুর ১২টার সময় নিত্যভোগ হয়, তারপরে ঠাকুরের শয়ন।

এরপর শীতকাল এবং বর্ষাকাল মেনে ঠাকুরকে ঘুম থেকে তোলা। সন্ধ্যেবেলায় সেঁতল তারপর রাত ৮.৩০ করে ঠাকুরের শয়ন। এরপরেই মন্দিরের সবাই নিজেদের বাড়ি ফেরেন।

এই রাধাবল্লভ জিউর মন্দিরের নাম থেকেই অঞ্চলটির নাম হয় বল্লভপুর।

নিত্য সেবার পাশাপাশি বছরের বিভিন্ন সময় নানা উৎসবে সেজে ওঠে মন্দির চত্বর। ফুল দোল, স্নান যাত্রা, রাশ, গোষ্ঠ, ঝুলন, বিরাট উৎসব, মাঘী পূর্ণিমা সহ একাধিক উৎসবে জমজমাট আয়োজন হয় এই মন্দিরে। শ্রীরামপুরের এই মন্দিরে এলেই সব দর্শণার্থীদের মন শান্ত হয়েই যাবে।

কিভাবে আসবেন এই মন্দিরে? ট্রেনে করে শ্রীরামপুর স্টেশনে নেমে একটা টোটো করলেই আসা যাবে এই মন্দিরে।

তাহলে আর দেরি না করে এই শীতের ছুটিতে দিন বেছে ঘুরে আসুন এই জাগ্রত মন্দিরে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...
/****tag-carousel ends****/