মানুষের অনুপ্রেরণা নিমতা-হাওড়া রুটের মহিলা বাস ড্রাইভার প্রতিমা পোদ্দার

ঘরে বাইরে দশভূজা তিনি। সংসারের স্টিয়ারিং-এর সামলাতে শক্ত হাতে ধরেছিলেন বাসের স্টিয়ারিং। রুট নিমতা-হাওড়া। সব প্রতিকূলতা বশ মেনেছিল তাঁর জেদের কাছে। একটা সময় তাঁকে নিয়ে বেশ চর্চা হলেও আজ তিনি আড়ালে। কেমন আছেন বহু মানুষের অনুপ্রেরণা মহিলা বাস ড্রাইভার প্রতিমা পোদ্দার?

নিমতা-বেলঘরিয়া-হাওড়া রুটে যারা নিয়মিত যাতায়াত করেন তাঁদের কাছে প্রতিমা পোদ্দার পরিচিত মুখ। তাঁকে একবার দেখলে ভুলে যাওয়া অসম্ভব। এই রুটে গত এক দশকের বেশি সময় ধরে বাস চালান তিনি। বাংলায় মহিলা বাস ড্রাইভার হিসেবে বহু নারীর আদর্শ।

স্বামী ছিলেন গাড়ির চালকের পেশাতেই। তাই এই দুনিয়া তাঁর খুব একটা অজানা অচেনা ছিল না। ২০০৬ সালে স্বামীর কাছেই নিয়েছিলেন গাড়ি চালানোর পাঠ। কিন্তু তখন আটপৌরে গৃহবধূ প্রতিমা কখনও ভাবেননি স্টিয়ারিং ধরবেন পেশার খাতিরে।

কন্যা আর সংসারের প্রয়োজনে একদিন বদল এলো তাঁর ভাবনায়। পুরোদস্তুর বাস চালক হবেন- লোক, সমাজ, পরিজন সব মিলিয়ে দ্বিধার ভাবনা কম আসেনি। কিন্তু পাশে পেয়েছিলেন শাশুড়ি মা আর জীবনসঙ্গীকে। এই দুটি মানুষ স্তম্ভ হয়ে সাহস যুগিয়েছিল।

প্রতিমা যখন পেশা জীবনে প্রবেশ করেন তখন তাঁর শাশুড়ি নব্বই ছুঁয়েছেন। উৎসাহ যুগিয়েছিলেন পুত্রবধূকে। বলেছিলেন ‘ পাড়া প্রতিবেশি সমাজ যাই বলুক, ওদিকে তাকিও না। সব বাঁকা কথা একদিন বদলে যাবে সম্ভ্রমে’। তাঁর পরামর্শেই ঘোমটা ঢাকা প্রতিমা পোশাপ হিসেবে বেছে নেন সালোয়ার-কামিজ। কারণ শাড়ি পরে বাস চালানো কঠিন।

বিয়ের পর বারো বছর কেটেছিল শুধুমাত্র স্বামী-সংসার-সন্তান নিয়ে। তারপর বিপরীত স্রোতে হাঁটা। তাঁর স্বামী বলেছিলেন, ‘মেয়েরা সব পারে। তোমায় দেখে সাহসী হবে তোমার মেয়েরাও’।

সেই সাহসই আজও প্রতিমার প্রতিদিনের চালিকাশক্তি। স্টিয়ারিং ধরার সব ভয় কেটে গেছে। তাঁর কথায় গাড়ি চলতে শুরু করলে আর ভয় থাকে না। তখন শুধু মানুষকে নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছানোর দায় আর দায়িত্ববোধ কাজ করে। সেই লক্ষ্যেই সম্ভব হয়েছে অসাধ্য সাধন।

প্রতিদিন রাত থাকতেই ঘুম ভাঙে। ভোর সাড়ে তিনটেতে দিন শুরু হয় তাঁর। নিমতা-বেলঘরিয়া-হাওড়া দু’ ট্রিপ সেরে এসে শুরু হয় তাঁর দ্বিতীয় পর্বের কাজ। সংসারের খুঁটিনাটি সব কিছু একা হাতে সারেন। দুই মেয়ে জাতীয় স্তরের খেলোয়াড়। বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞানের ছাত্রী। তাদেরকে শক্তপক্ত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেন তিনি। মেয়েদের কথায় আবেগে থরথরে গলায় তাই বলেন, ‘আমি তো সেই বাঙালি মা...’

একটা সময় ‘ঘরের বউ-এর এভাবে বাসে স্টিয়ারিং ধরার ঘৎনা খুব ভাল ভাবে নেয়নি মানুষ। বাধা এসেছে পদে পদে। কিন্তু সব বাধা তিনি জয় করেছেন নিজের লড়াই আর পরিশ্রম দিয়ে। কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষ কাজের ভাগ কী বদলেছে? তাঁদের দেওয়াল ভাঙ্গার উদাহরণ কতটা ভাবিয়েছে মানুষকে?

এ কথায় তাঁর বক্তব্য, ‘কাজ নারীর বা পুরুষের নয়, কাজ সবার’। মা-স্ত্রী-সহোদরা-কন্যার কাজ ভাগ করে নিলে জোর বাড়ে। সমাজ এগোয়।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...