প্রবীণ নাগরিকদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে কোন কোন দিকগুলি বিশেষ খেয়াল রাখা উচিত?

বয়েস বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রুটিন চেকআপ কতটা প্রয়োজনীয়? প্রবীণ নাগরিকদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে কোন কোন দিকগুলি বিশেষ খেয়াল রাখা উচিত? শরীরের পাশাপাশি তাঁদের মনের স্বাস্থ্যের খোঁজ রাখা কতটা গুরুত্বপূর্ণ,  বিস্তারিত জানালেন, বার্ধক্য চিকিৎসক ডাঃ ধীরেশ কুমার চৌধুরী  (Dr. Dhires Kumar Chowdhury, Geriatrician)

বার্ধক্য চিকিৎসা প্রসঙ্গে  ডাঃ ধীরেশ কুমার চৌধুরী জানিয়েছেন,  'বাঁচব' পূর্ব ভারতে প্রথম ২৪×৭ এল্ডারলি সাপোর্ট সংস্থা। ৯৫ সালে সংস্থার জন্ম। বয়স্ক নাগরিকদের জন্য বিভিন্ন ধরনের কাজ করে থাকে সংস্থা। এই সংস্থার একটি ইউনিট আছে 'বাঁচব হিলিং টাচ' নামে। ২০০৭ সালে কলকাতায় প্রথম জেরিয়াট্রিক হোম বেসড সাপোর্ট শুরু করে। এই মুহূর্তে প্রায় ৪৫০ জন প্রবীণ এই পরিষেবার আওতায় আছেন। অতীতে পরিবারের বয়স্ক সদস্যদের বাড়িতে রেখেই চিকিৎসা করা হত। পশ্চিমীদেশেও তাই। আঠারো শতকের আমেরিয়ায় 'বেনিভায়োলেন্ট লেডিস সোসাইটি' নামে একটি সংস্থা তৈরি হয় যারা হোম বেসড নার্সিং ব্যবস্থা শুরু করে। ভারতে সেই ব্যবস্থা শুরু হতে সময় নেয়। যদিও এক সময় মধ্যবিত্ত বাঙালি ও ভারতীয় পরিবার 'গৃহ চিকিৎস' থাকত।

বয়স্ক মানুষদের যেহেতু নানা ধরনের অসুস্থতা থাকে তাই তাঁদের এমন একজন চিকিৎসক বা দলের দায়িত্বে থাকা উচিত যারা নিত্য নৈমিত্তিকভাবে শরীর স্বাস্থ্যের খোঁজ রাখতে পারবে।  সেই দেখেই বোঝা যাবে চিকিৎসার গতি প্রকৃতি।

কলকাতায় প্রতিদিন নিঃসঙ্গ প্রবীণ নাগরিকদের সংখ্যা বাড়ছে। ৭২ শতাংশ প্রবীণ মানুষ হয় তাঁরা একা, নয়, স্ত্রী/স্বামীর সঙ্গে থাকেন। সন্তান ও আত্মীয়রা দূরে, বিদেশে থাকে। প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষের জীবন কেয়ার গিভার্স নির্ভরশীল। বিছানাবন্দী মানুষের সংখ্যাও কম নয়। হাসপাতালে তাঁদের আসার থেকে হাসপাতালকে পৌঁছতে হবে তাঁদের কাছে। সেই জায়গা থেকেই এই হোম বেসড সাপোর্ট সিস্টেম তৈরি হয়।  প্রিভেন্টিভ চেক আপ মানে প্রতিরোধমূলক চিকিৎসা। প্রয়োজনে প্রতি মাসে বা দু মাস অন্তর চিকিৎসকরা গিয়ে বাড়িতে গিয়ে চেক আপ করেন। দ্বিতীয়ত এমার্জেন্সি বা আপতকালীন ব্যবস্থা। ২৪ ঘন্টাr হেল্প লাইন নম্বর আছে। যে কোনও সময় দরকার পড়লে সাহায্যকারী সংস্থার মেডিকেল টিম ও ইউনিট রোগীর কাছে উপস্থিত হয় জরুরি পরিষেবা দিতে। সেই মুহূর্তে রোগীকে যদি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন হয় তাহলেও সাহায্য পাওয়া যায়।

কেয়ার ৩৬৫ বলেও একটি সার্ভিস আছে। দৈনন্দিন কাজের ক্ষেত্রে কেয়ার দেওয়া হয় যার মাধ্যমে।

আমাদের দেশে ৬০ বছর বয়সের উর্দ্ধের মানুষকে প্রবীণ বা বয়স্ক হিসেবে ধরা হয়। ৬০-৮০ একজন  মানুষের আনুমানিক জীবৎকাল। কিন্তু এই সময়টাকে নিয়ে খুব একটা ভাবা হয় না। কর্মক্ষেত্র থেকে অবসর গ্রহণ করলেও তাঁরা কর্মক্ষম থাকেন অনেকেই। ফলে এঁদের নিয়ে চিন্তাভাবনা জরুরি। বয়স্ক মানুষদের তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়। ৬০-৭০ ইয়াংগার ওল্ড। ৭০-৮০ মিডিল ওল্ড। আর ৮০ বছরের ওপরে ওল্ডার ওল্ড। সমস্যাগুলিও এভাবেই আসে। ওল্ডার ওল্ড-এর  অসুস্থতাজনিত সমস্যা সবচেয়ে বেশি। যত বয়স বাড়ে প্রকৃতির নিয়মে প্রতিটা অঙ্গে ক্ষয় জনিত সমস্যা তৈরি হতে শুরু করে। সকলের ক্ষেত্রে একই রকমের গতিতে হয় না। কো মর্বিডিটিজ দেখা দেয়।  তার মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, থাইরয়েড, চলাফেরায় সমস্যা, পার্কিনসন্স, কোষ্ঠকাঠিন্য, প্রস্রাব সমস্যা, মহিলাদের গাইনোকলজিক্যাল সমস্যা এবং সেই সঙ্গে মানসিক সমস্যাও তৈরি হয়। শারীরিক সমস্যা নিয়ে আমরা যতটা ভাবি মন নিয়ে ততটা ভাবা হয় না। তাঁদের মধ্যে 'আমরা ব্রাত্য' এরকম ভাবনা চলে আসে। বার্ধক্য মানুষের দ্বিতীয় শৈশব। প্রথম শৈশব মানুষের যতটা প্ৰিয় দ্বিতীয় শৈশব ততটাই অনাকাঙ্খিত। এই জায়গায় মানসিক সমস্যা একটা বড় সমস্যা। অবহেলা, একাকিত্ব, পরিবারের কাছে বোঝা এমন ভাবনা থেকেই অবসাদ আসে। এমনকি আত্মহত্যার ঘটনাও দিন দিন বাড়ছে।  সমাজের সব স্তরের বয়স্ক মানুষের মধ্যেই এই প্রবণতা বাড়ছে। তাঁরা অনেক সময় মনে করেন তাঁরা সামাজিকভাবে ব্রাত্য সেটাও একটা সমস্যা।

অন্যের ওপর পুরোপুরি নির্ভর না করে নিজেকেও নিজের ভাল রাখার দায়িত্ব নিতে হবে। অবসরের পর কর্মদক্ষতাকে হারাতে দেওয়া চলবে না। অবসরব গ্রহণের আগেই পরিকল্পনা করতে হবে অবসরের পরের জীবনের। বিভিন্ন পেশাদার ও সামাজিক কর্মকান্ডে যুক্ত থাকতে হবে। যে সমস্ত নিজের শখ বা কাজ কর্ম জীবনের ব্যস্ততার কারণে করতে পারেননি অবসরে সেই কাজ নতুন আনন্দ ও জীবনের আলাদা মানে খুঁজে দিতে পারে। পরিবারের সদস্যদের প্রজন্ম দূরত্ব ভাঙতে হবে। বয়স্ক সদস্যের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। সহানুভূতি নয় সহমর্মিতা চাই।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...