কেরিয়ারে প্রথম গোল করার পর উপহার পেয়েছিলেন একটা প্রাইভেট কার

ফুটবল বিশ্বে অনেক বছর ধরেই বিতর্ক চলছে সেরা ফুটবলার কে তা নিয়ে। ফিফার নির্বাচন অনুযায়ী পেলে, মারাদোনা দুজনই সেরা ফুটবলার হলেও জনপ্রিয় ওয়েবসাইট ইয়াহুর করা এক সমীক্ষায় বিশ্বের সেরা ১০ নম্বর জার্সিধারী খেলোয়াড় হলেন জিনেদিন জিদান!

সর্বাধিক ৪৩ শতাংশ ভোট পেয়ে জিদান এই সমীক্ষায় সেরা নির্বাচিত হন। জিদানের চেয়ে ৩২৮ ভোট কম পেয়ে দ্বিতীয় হয়েছেন মারাদোনা। স্বভাবতই তৃতীয় স্থানে পেলের থাকার কথা থাকলেও তৃতীয় স্থানটি দখল করেন ব্রাজিলের জিকো। জিকো এই জরিপে ১০ শতাংশ ভোট পান। ৩ শতাংশ ভোট পেয়ে এই জরিপের চতুর্থ স্থানে রয়েছেন ফ্রান্সের প্লাতিনি। আর ১ শতাংশ ভোট পেয়ে পঞ্চম ও ষষ্ঠ স্থানে রয়েছেন যথাক্রমে শিফো ও ভালদেরামা। আর সপ্তম স্থানে রয়েছেন পেলে।

গতি ছিল না তেমন, তাই বলে আটকে রাখতে পারেনি কেউ। অসাধারণ ড্রিবলিং, পাসিং, টেকনিক দিয়ে গোল করেছেন, করিয়েছেন, খেলার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছেন। ছয় বছর ধরে ‘ফিফা প্লেয়ার অফ দ্য ইয়ার’-এর প্রথম তিনজনের মধ্যে ছিলেন। তার মধ্যে প্রথম হয়েছেন ৩ বার। চ্যাম্পিয়নস লীগের গত ২০ বছরের ইতিহাসে সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়েছেন। ই্উরো, বিশ্বকাপ, শীর্ষ দুই ইউরোপিয়ান লীগ, চ্যাম্পিয়ন্স লীগ জিতেছেন। ছোটখাটো কাপের কথা না হয় বাদই দিলাম! সঙ্গে জয় করেছেন কোটি মানুষের হৃদয়। জায়গা করে নিয়েছেন সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলারের তালিকায়! ফুটবলের প্রতি তার ভালোবাসা অকৃত্রিম। তাই নিজে যেমন ফুটবলকে দিয়েছেন অসাধারণ কিছু মুহূর্ত তেমনি ফুটবলও তাঁকে দিয়েছে দু’হাত ভরে!

১৯৯৮ সালে জিদান জিতে নেন ব্যালন ডি'অর এবং "FIFA World Player of the Year"(তখন এ দুটো পুরস্কার আলাদা ছিল)। ২০০৪ সালে ফোর্বস ম্যাগাজিন জিদানকে বিশ্বের ৪২তম সর্বোচ্চ সম্মানীপ্রাপ্ত খেলোয়াড় হিসেবে ঘোষণা করে। ২০০১ সালে ইউএনডিপির "দারিদ্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ" বিষয়ক কর্মসূচির জন্য জাতিসংঘের শুভেচ্ছা দূত হিসেবে নিযুক্ত হন। বিশ্বের মাত্র ২৫ জন খেলোয়াড়ের সৌভাগ্য হয়েছে ক্যারিয়ারে চ্যাম্পিয়নস লিগ, বিশ্বকাপ, ইউরো এবং কনফেডারেশনস কাপ – এই চারটি বড় শিরোপা জেতার। জিদান তাঁদের মধ্যে একজন।

'ফ্রান্সে সবাই বিশ্বাস করে যে, ঈশ্বর আছেন। আর তিনি ফ্রান্স আর্ন্তজাতিক ফুটবল দলে ফিরে এসেছেন। ঈশ্বর ফিরেছেন, এর চেয়ে আর বেশী কী বলার আছে!'

অবসর ভেঙ্গে ফিরে আসার পর জিদান সম্পর্কে সতীর্থ থিয়েরি অঁরি কথাটি বলেছিল। ফ্রান্স ফুটবলে তার গুরুত্ব বোঝানোর  জন্য হয়তোবা এই কথাটিই যথেষ্ঠ ছিল। ফ্রান্স ফুটবলে জিদানের গুরুত্ব আসলে বিশাল! জিনেদিন জিদান ফ্রান্স ফুটবলের রেনেসাঁস; যার মাধ্যমেই ফরাসি ফুটবলে একটা বিপ্লব এসেছিল।

যদি টেকো মাথার এই লোকটা না থাকত; তাফারেলকে এত অসহায় দেখাত না। হয়তো ব্রাজিলের নামের পাশে আরও দুইখানা বিশ্বকাপও যোগ হতে পারত। এতদিন সেলেকাওরা যে হেক্সা জয়ের স্বপ্নে বিভোর সেই ব্রাজিলিয়ানদের স্বপ্নটা  তো অনেক আগেই পূরণ হয়ে যেত। একজন জিদানের কাছে সেই স্বপ্নটাই শেষ হয়েছে দু’বার। জিদান ব্যতিত বিশ্বকাপে ব্রাজিলকে ব্যক্তিগতভাবে এতটা যন্ত্রণা দিতে পারেনি আর কোনও ফুটবলার।

 

zidane (2)

 

কিছু অজানা জিদান

 

প্রফেশনাল ফুটবল কেরিয়ারে প্রথম গোল করার পর উপহার পান একটি প্রাইভেট কার। ১৯৯২ সালেই ফ্রান্স ক্লাব ক্যানেসের হয়ে প্রথম গোল করার পর ক্লাব প্রেসিডেন্ট হুয়ান লাপোজ জিদানকে এই উপহার দেন।

১৯৯৮ বিশ্বকাপে জোড়া গোল করে একাই ব্রাজিলকে হারিয়ে ফ্রান্সকে প্রথমবার বিশ্বকাপ জেতান জিদান। ইন্টারেস্টিং বিষয়, পুরো কেরিয়ারে শুধু ব্রাজিল ছাড়া অন্য আর কোন লাতিন আমেরিকান দলের বিপক্ষে গোল করার রেকর্ড নাই জিদানের! ইভেন, ওই ম্যাচের পর লাতিন আমেরিকান কোন দলের বিপক্ষে কখনই গোলের দেখা পাননি জিজু।

দ্য গ্রেট পেলে, ভাবা,পল ব্রেইটনার সাথে যৌথভাবে দুটি ভিন্ন বিশ্বকাপ ফাইনাল গোল করা প্লেয়ার জিদান। ২০০৬ বিশ্বকাপে জিদানের বয়স ছিল ৩৪ বছর ১৬দিন। বিশ্বকাপে জিদানের চেয়ে বেশি বয়সে গোল্ডেন বলটা জিততে পারেনি আর কেউ!

২০০৬ বিশ্বকাপে সেই ‘ঢুশ স্ক্যান্ডাল’-এ লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়লেও তা জিদানের জন্য প্রথম ছিল না! ৯৮ বিশ্বকাপেই প্রথম ফরাসি ফুটবলার হিসেবে সৌদি আরবের বিপক্ষে লাল কার্ডের দেখা পান জিদান। গোটা কেরিয়ারে জিদান লাল কার্ডের দেখা পান আরও ষোলবার। বিশ্বকাপ ইতিহাসে কাফু ও রাফায়েল মার্কেজের সঙ্গে যৌথভাবে সর্বাধিক ৬টি কার্ড দেখা প্লেয়ারও হল জিদান।

ইতিহাসে কেবল একজন মাত্র ফুটবলার বিশ্বকাপ ও উয়েফা ইউরো টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়েছেন। ইতিহাসে মাত্র একজন ফুটবলার খেলোয়াড় এবং কোচ উভয়েই IFFHS বেস্ট প্লে-মেকারের পুরস্কার জিতেছেন। উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লীগের ইতিহাসে মাত্র একজন কোচ হ্যাট্রিক শিরোপা জিতেছেন। আর তিনি?  তিনিই হলেন জিনেদিন ইয়াজিদ জিদান।

ক্লাব এবং জাতীয় দল সবমিলিয়ে প্রায় ষোল বছরে জিদান ম্যাচ খেলেন ৭১৮টি। অবাক হলেও সত্য,  এত বছরের কেরিয়ারে কখনই অফসাইডে ট্র‍্যাপে পড়তে হয়নি তাকে।

রিয়াল মাদ্রিদ প্রথম ফ্রেঞ্চ কোচ জিনেদিন জিদান। রিয়াল মাদ্রিদকে সর্বাধিক ৭টি ইউরোপীয়ান ও ইন্টার. ট্রফি জেতানো কোচও জিদান।

মিডফিল্ডার জিদান ক্যারিয়ারে হ্যাট্রিক করেন মাত্র একটি। ২০০৬ সালে রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে শেষ মরসুমে লীগে ভিয়ারিয়ালের বিপক্ষে হ্যাট্রিকটি করেন।

জিদানের গোল নিয়ে কথা হবে;  কিন্তু চ্যাম্পিয়নস লীগ ফাইনালে লেভারকুসেনের সেই বলিতে করা গোলের কথা আসবে না তা হতেই পারে না। ২০০২ উচলের ফাইনালে মাইকেল বালাকের বায়ার লেভারকুসেনেরর বিপক্ষে জিদান গোলটি করেছিলেন উইক ফুট বাম পা দিয়েই। গোল করার পর সেলিব্রেশনের সময়ে দৌড় দেন প্রায় ৬০ মিটার. দূরত্ব। ২০১৭ সালের এক সমীক্ষায় এই গোলটি চ্যাম্পিয়নস লীগ ফাইনাল ইতিহাসে সেরা গোল নির্বাচিত হয়।

লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির তুলির আঁচড়ে ফুটিয়ে তোলা সেই অনিন্দ্যসুন্দর চিত্রকর্মকে যেমন বিশ্লেষণ করা যায় না;  মার্বেল পাথরে তৈরী মমতাজ আর সম্রাট শাহজাহানের কীর্তি আগ্রার তাজমহল যেমন কোনভাবে বিশেষায়িত করা যায় না তেমনি একজন জিদানকেও কী-বোর্ডের কোনভাবে বর্ণনা করা সম্ভব না। জিদান তাই বর্ণনার উর্ধ্বে।

জিনেদিন জিদান এক মহীরুহ। যার অস্থিমজ্জায় ছিল ফুটবল! খেলার মাঠে কিংবা মাঠের বাহিরেও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তার এক নিদারুণ স্নিগ্ধতায় মাতিয়েছিল পুরো ফুটবল বিশ্বকে। রাইভাল হোন কিংবা ফ্যান অসাধারণ সব ফুটবলশৈলী তাকে বানিয়েছে সবার প্রিয়পাত্র। ফুটবল, ফুটবল বিশ্বকাপ, ফ্রান্স কিংবা ব্রাজিল ফুটবলকে নিয়ে যত দিন আলোচনা হবে তার মধ্যে জিদান নামটাও যে অনেক উপরে উচ্চারিত হবে তা হলফ করে বলা দেওয়া যায়।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...