জনশ্রুতি অভিনেতা দিলীপকুমার তাঁকে ভারতীয় ক্রিকেট দলে নির্বাচনের জন্য আর্জি জানিয়েছিলেন

সব শুরুরই একটা শুরু থাকে। ১৯৮৩র বিশ্বকাপ জয়কে আজও কেউ বলেন "ফ্লুকে জয়",কেউ বলেন "টিমএফর্টের জয়" আবার কেউ বা বলেন "অলরাউন্ড পারফর্মেন্সের জয়"। কিন্তু ২৫ জুন ১৯৮৩র বিশ্বকাপ জয়ের  মাস তিনেক আগে, ২৯ মার্চ ১৯৮৩তে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বার্বিসে "আমরাও পারি"র বিশ্বাসের তেলে প্রথম সলতে পাকিয়েছিল ভারত (৪৭ ওভারে ২৮২/৫), ওডিআই সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচে, ২৭ রানে প্রবল পরাক্রমশালী ওয়েস্ট ইন্ডিজকে (৪৭ ওভারে ২৫৫/৯), হারিয়ে দিয়ে।সেই ম্যাচে ২৬ বলে ৩টি ঝকঝকে চারসহ ২৩ রান করা ছাড়াও রবি শাস্ত্রীর বলে ফাউদ বাক্কাসের ক্যাচ নিয়েছিলেন এক গাঁট্টাগোট্টা ভারতীয় ক্রিকেটার। তিনি, যশপাল শর্মা, ১৯৫৪র ১১ আগস্ট যার জন্ম হয়েছিল লুধিয়ানায়। আন্ডাররেটেড হয়েই তিনি সারা জীবন থেকে গিয়েছেন ক্রিকেটের মত জীবনেও।

১৯৮২-৮৩র সেই ৩ ম্যাচের ওডিআই সিরিজ ১-২ ফলে হেরেছিল ভারত আর ৫ ম্যাচের টেস্ট সিরিজ হেরেছিল ০-২ ফলে। ৫ টেস্টে ৯ ইনিংস খেলে ২টি অর্ধশতকসহ ২২২ রান আর ৩ ওডিআই ম্যাচ খেলে ৫৩ রান করেছিলেন সেই ভারতীয় ক্রিকেটার। এইরকমই চোখ না টানা পারফরমেন্স করেও "টিমম্যান" হয়ে টিমের জন্য সর্বস্ব দিয়ে দিতেন তখন তিনি, যশপাল শর্মা। তবু আন্ডাররেটেড হয়েই তিনি সারা জীবন থেকে গেছেন ভারতীয় ক্রিকেটে।

২ আগস্ট ১৯৭৯ থেকে ২৯ অক্টোবর ১৯৮৩র মধ্যে ৩৭টি টেস্ট খেলে ২টি শতরান ও  ৯টি অর্ধশতরান এবং সর্বোচ্চ ১৪০ রান (বনাম ইংল্যান্ড, চেন্নাইতে) সহ ৩৩.৪৫ গড়ে ১৬০৬ রান করেছিলেন যশপাল শর্মা।আর ১৩ অক্টোবর ১৯৭৮ থেকে ২৭ জানুয়ারি ১৯৮৫র মধ্যে ৪২টি ওডিআই খেলেছিলেন তিনি, রান করেছিলেন ৮৮৩, ২৮.৪৩ গড়ে, যার মধ্যে ছিল ৪টি অর্ধশতরান আর সর্বোচ্চ ছিল ভারতের জেতা ১৯৮৩র বিশ্বকাপের ১ম ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে করা ৮৯।টেস্ট আর ওডিআই, দুই ধরণের ক্রিকেটেই ডানহাতি মিডিয়াম ফাস্ট বোলিং তাকে এনে দিয়েছিল ১টি করে উইকেটও। দেখনদারি না, কার্যকরী ক্রিকেটেই অভ্যস্ত ছিলেন তিনি, যশপাল শর্মা। ১৯৭৯র বিশ্বকাপে ভারতীয় স্কোয়াডে থাকা তিনি একটি বলের জন্যও মাঠে নামেননি। ১৯৮১-৮২তে চেন্নাইতে গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথ (২২২) আর তিনি (১৪০) জুটিতে ৩১৬ রান করার পথে একটা গোটা দিন ব্যাট করে অপরাজিত থেকে গিয়েছিলেন ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে, যার স্মৃতিচারণ করেছেন আজ বিশ্বনাথ। তবে তাঁর আসল মাস্তানি ছিল দু'দশক জুড়ে বিস্তৃত ১ম শ্রেণীর ক্রিকেটে, ১৬০ ম্যাচে ৮৯৩৩ রান (২১ শতরান, ৪৬ অর্ধশতরান) সাক্ষ্য দেয় একথার স্বপক্ষে। তবু আন্ডাররেটেড হয়েই তিনি সারা জীবন থেকে গেছেন ভারতের ক্রিকেটে।

অতঃপর ৯-২৫ জুন, ১৯৮৩র বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের প্রখর গ্রীষ্মকালকে নিজের ক্রিকেট কেরিয়ারের বসন্তদিনে পরিণত করার সিদ্ধান্ত নিলেন সেই তিনি, যশপাল শর্মা। ৯ জুন ১৯৮৩,  বিশ্বকাপের প্রথম গ্রুপ ম্যাচেই ওল্ড ট্রাফোর্ডে ভারত হারাল তখন দুরন্ত, তখনো আয়োজিত ২টি বিশ্বকাপই জেতা ওয়েস্ট ইন্ডিজকে, আড়াই মাসের মধ্যে ২য় বার।তখন ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ওডিআই-তে হারানোর চেয়ে অসম্ভব খুব কম জিনিসই ছিল বিশ্ব ক্রিকেটে। সেই ওল্ড ট্রাফোর্ডের ম্যাচে ৮৯ রান (৯X৪) করে ভারতকে জয়ের রাস্তা দেখিয়েছিলেন তিনি, যশপাল শর্মাই।আর একটি গ্রুপ ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ২০ জুন চেমসফোর্ডে তাঁর ৪০ রান আজও চর্চার বিষয়, ভারতীয় ক্রিকেটে।কিন্তু আজও সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয় ওল্ড ট্রাফোর্ডের সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ২২ জুন তারিখে তাঁর করা ৬১ রান (৩X৪, ২X৬) নিয়ে, সন্দীপ পাতিল ও মহিন্দার অমরনাথকে সঙ্গে নিয়ে ৫০:৫০ ম্যাচ যিনি অনায়াসে নিয়ে গিয়েছিলেন ভারতের জিম্মায়। তিন দিন পরের লর্ডস ফাইনালে অবশ্য মাত্র ১১ রানে প্যাভিলিয়নে ফিরেছিলেন তিনি। ৮ ম্যাচে ২৪০ রান করেছিলেন তিনি সেই বিশ্বকাপে, ৩৪.২৮ গড়ে। তবু, তবুও সারা জীবন ভারতীয় ক্রিকেটে আন্ডাররেটেড হয়েই থেকে গেছেন যশপাল শর্মা। 

জনশ্রুতি আছে সদ্যপ্রয়াত অভিনেতা দিলীপকুমার তাকে ভারতীয় ক্রিকেট দলে নেবার জন্য রাজ সিং দুঙ্গারপুরের কাছে আর্জি জানিয়েছিলেন।হয়ত তাই, হয়ত নয়, ভারতীয় ক্রিকেট দলে ঢুকেছিলেন যশপাল শর্মা। এবং তারপর নিজের ১০০ শতাংশ দিয়ে দেওয়া খেলা দিয়েই তিনি অমর থেকে গেছেন ভারতের ক্রিকেটে, বিশেষত প্রথম বিশ্বকাপ জেতায়। টেকনিকালি খুব সাউন্ড ছিলেন তিনি, কেউ কখনো বলবেনা, কিন্তু দলের জন্য তাঁর পরিশ্রম আর চেষ্টা ছিল সশব্দ। খেলা ছাড়ার পরে ধারাবিবরণী ও আম্পায়ারিং করেছিলেন যোগ্যতার সাথে। ২ দফার নির্বাচক ছিলেন তিনি, ২০০৪-২০০৫ আর ২০০৮-২০১১য়। চ্যাপেল অধ্যায়ে খোলাখুলি অধিনায়ক সৌরভের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন যশপাল, উচিত কথা সোজাসাপটা বলে দিতে যার কোন জুড়ি ছিলনা। সৌরভকে দলে রাখার জন্যে চ্যাপেল, মোড়ে, দ্রাবিড়, শরদ পাওয়ার সবার বিরুদ্ধে গিয়ে ২০০৬ এর শ্রীলঙ্কা এবং পাকিস্তান সফরের দল নির্বাচনি সভায় লড়াই করেছিলেন। অনেকে বলেন "সেই অপরাধেই তাঁর এবং গোপাল শর্মার চাকরী যায়। যে সাহস নিয়ে মধ্যমমানের ক্রিকেটার হয়েও মার্শাল, গারনারদের সামলেছিলেন সেই সততা এবং সাহস নির্বাচক হিসাবেও দেখাতে পেরেছিলেন। তবুও ভারতীয় ক্রিকেটে আন্ডাররেটেড হয়েই সারা জীবন থেকে গেছেন ভারতীয় ক্রিকেটের প্রথম দিকের এই "শর্মাজী কা বেটা"।

১৯৮৩র সেই বিশ্বজয়ী টিমের প্রথম তিনিই ‘আউট’ হয়ে গিয়েছেন মৃত্যুর বোলিংয়ে। ক্রিকেটের এক ঐতিহ্য ও আদরের মণিমুক্তোর সেট থেকে,  চেষ্টা করে যাওয়াই ছিল তাঁর জীবনের মূলমন্ত্র, ব্যাটিং-বোলিং আর ফিল্ডিংয়েও ছিল সেটাই। ১৯৭২ সালে পঞ্জাব স্কুলস দলের হয়ে জম্মু ও কাশ্মীর স্কুলস দলের বিরুদ্ধে ২৬০ রান করে নজর কেড়ে নেন যশপাল। এই ইনিংস খেলার দুবছরের মধ্যে তিনি রাজ্য দলে সুযোগ পেয়ে যান। উত্তরাঞ্চলের হয়ে বিজয় হাজারে ট্রফিতেও খেলার সুযোগ পান তিনি। সেবার তাঁদের দলই এই প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়। এরপর দলীপ ট্রফিতে চন্দ্রশেখর, এরাপল্লী প্রসন্ন, বেঙ্কটরাঘবন সমৃদ্ধ দক্ষিণাঞ্চলের বিরুদ্ধে ১৭৩ রান করে চমক দেন যশপাল। পরের মরসুমে ইরানি ট্রফিতে ৯৯ রানের ইনিংস খেলার সুবাদে পাকিস্তান সফরের জন্য ভারতীয় দলে সুযোগ পান তিনি। সেবার তিনি দুটি একদিনের ম্যাচ খেলার সুযোগ পান। পরের বছর ইংল্যান্ড সফরেও সুযোগ পান তিনি। ১৯৭৯ সালের বিশ্বকাপেও ভারতীয় দলে ছিলেন তিনি। তবে সেবার একটি ম্যাচেও খেলার সুযোগ পাননি। বিশ্বকাপের পরে টেস্টে অভিষেক হয় তাঁর।

১৯৭৮ থেকে ১৯৮৫ পর্যন্ত ভারতীয় দলের হয়ে খেলেন যশপাল। ১৯৭৮ সালের ১৩ অক্টোবর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একদিনের আন্তর্জাতিকে অভিষেক হয় তাঁর। শেষ একদিনের আন্তর্জাতিক ১৯৮৫ সালের ২৭ জানুুয়ারি ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে। ১৯৭৯ সালের ২ ডিসেম্বর ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে টেস্টে অভিষেক হয় যশপালের। ১৯৮৩ সালের ৩ নভেম্বর থেকে শুরু হওয়া টেস্টই এই ফর্ম্যাটে তাঁর জীবনের শেষ ম্যাচ।

রঞ্জি ট্রফিতে হরিয়ানা ও রেলওয়েজের হয়ে খেলতেন যশপাল। তিনি ১৬০টি ম্যাচ খেলে ৮,৯৩৩ রান করেন। রঞ্জি ট্রফিতে তাঁর শতরানের সংখ্যা ২১। সর্বোচ্চ স্কোর অপরাজিত ২০১। এরপরেও তিনি আন্ডাররেটেড। 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...