পরিবেশ ও মেয়েরা

উত্তর ভারতের লাতুর জেলা। জলের অভাব মেটে না কিছুতেই। সারাদিনের জল ধরে রাখতে হয় একবারেই। কোন কারণে নির্দিষ্ট হয়ে থাকা প্রয়োজনের অন্যথা হলেই নেমে আসে বিপত্তি। তখন প্রয়োজন‌ আর সুবিধার যুদ্ধ চলে। ভুক্তভোগী হয় ওই অঞ্চলে বসবাসকারী সকলেই। কিন্তু ধানীর সমস্যাটা সবসময়ই বেশি। ওর বর ওই অঞ্চল থেকে প্রায় তিরিশ কিলোমিটার দূরে কাজ করে। সময় মতো সব গুছিয়ে দিতে হয় ধানীকে। কোন দিন সকালে জল না এলেই প্রায় পাঁচ কিলোমিটার হেঁটে জল আনতে যেতে হয় ওকে। সেই হাঁটাপথে সহ্য করতে হয় আগুনতাপা রোদ, কখনো বাঁকা চাউনি, অশ্লীল মন্তব্য। তবুও দিনের শেষে পরিবারের প্রয়োজন মেটাতে ফুরিয়ে যায় সবটুকু প্রাণশক্তি। তাই সময় নেই নিজের জন্যে। ও জানে, বাকি জীবনটা এভাবেই কাটবে। দারিদ্র্যের সঙ্গে যুঝতে হয় ওদের পরিবারকে। কিন্তু লড়াইটা ধানীর জন্য সবসময়ই খুব কঠিন। খুব জানতে ইচ্ছে করে এই যে প্রকৃতি এমন করে শাস্তি দেয় ওদের তার জন্য দায়ী কে? উত্তর নেই ধানীর কাছে। ও শুধু জানে প্রকৃতিকে অবহেলা করে বাঁচার উপায় নেই ওদের। তাইতো সঠিক সময়ে বৃষ্টি হওয়া, মেঘ করার জন্য পুজো করতে হয় ওদের। জীবনের কঠিন রোদ ওকে সারাবছর এভাবেই নিংড়ে নেয়।

কে এই ধানী? এক গ্রাম্য সরল মহিলা। এরা হয়তো অপরিচিতই সকলের কাছে। কিন্তু এমন অজস্র ধানী প্রকৃতির সুস্বাস্থ্যের অভাব সংক্রান্ত অনেক সমস্যার সঙ্গে এভাবেই লড়াই করে চলেছে। ধানীর ক্ষেত্রে সমস্যাটা জলের অভাব, কারোর ক্ষেত্রে হয়তো মুক্ত বাতাসের অভাব, কারোর ক্ষেত্রে হয়তো পরিবেশ দূষণের সমস্যা।

ইউনাইটেড নেশনস এনভারমেন্ট প্রোগ্রাম অর্থাৎ ইউনেপের করা সাম্প্রতিক সমীক্ষায় জানা গেছে প্রকৃতির অসুস্থতা প্রভাব ফেলে লিঙ্গ সাম্যের ক্ষেত্রেও। আমাদের যে সমস্ত সমস্যা লিঙ্গবৈষম্যের দিকে আরো বেশি করে সমাজকে ঠেলে দেয় তার মধ্যে পরিবেশ একটি।

জাতিপুঞ্জের মতে প্রাকৃতিক সম্পদের বন্টনের ক্ষেত্রে অনেক সময়ই মহিলারা বৈষম্যের শিকার হন। অথচ পরিবেশের সম্পদ থেকে সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে তাদের সমান অধিকার রয়েছে ‌।

অর্থনৈতিক উন্নতি সত্বেও প্রায় তিরিশ কোটি মানুষ শুধুমাত্র এশিয়া মহাদেশেই দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করেন এখনও। মহিলাদের ক্ষেত্রে লড়াইটা একটু বেশি। প্রাকৃতিক দূর্যোগ, পরিবেশের সম্পদের সমবন্টনের অভাব আবার এই দারিদ্র্যের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে অনেকটা।

পরিবেশ দূষণের জন্য যে ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় সাধারণ মানুষকে মহিলারা এক্ষেত্রেও বেশি লড়াই করেন। বিশেষজ্ঞরা কয়েকটি বিষয়কে চিহ্নিত করেছেন। যেমন- পরিবেশ দূষণের প্রভাব শুধুমাত্র বাড়ির বাইরেই থাকেনা, বাড়ির ভেতরেও থাবা বসায় এই সমস্যা। ফলে নানা রোগের শিকার হয় মেয়েরা। যেমন এখনো উনুনের ধোঁয়ায় রান্না করতে হয় অনেক মেয়েকে। এই ক্ষতিকারক ধোঁয়া শরীরে প্রভাব ফেলে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন ঋতুস্রাবের ক্ষেত্রেও কখনো এর প্রভাব মারাত্মক রূপে দেখা দেয়। আরেকটা বিষয়ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় মহিলা এবং শিশুদের মৃত্যুর হার অনেক বেশি। কারণ হিসেবে তাঁরা দেখাচ্ছেন, কোন প্রাকৃতিক দুর্ঘটনার সময় নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে মেয়েরা ততটা সচেতন নয় এখনো, নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়ে এখনো তাঁরা পুরুষদের উপর নির্ভরশীল।

তবে জাতিপুঞ্জ এই নিয়ে কাজ করছে। পরিবেশ, প্রকৃতির সুরক্ষা এবং তার সঠিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে লিঙ্গ সাম্যের চেষ্টা করছে জাতিপুঞ্জ। ইউনাইটেড নেশনস ন্এনভারমেন্ট প্রোগ্রাম-এর তরফ থেকে নেওয়া হয়েছে কয়েকটি পদক্ষেপ। যেমন বাড়ি এবং প্রকৃতির সুরক্ষার বিষয়ে মেয়েদের ওয়াকিবহাল করা, তাদের বোঝানো, সব মিলিয়ে পরিবেশ সুরক্ষার প্রয়োজনীয়তার ক্ষেত্রে মেয়েদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে তাদের সচেতন করার লক্ষ্যে কাজ করছে জাতিপুঞ্জ। প্রাকৃতিক শক্তির ব্যবহারের ক্ষেত্রেও মেয়েদের শিক্ষাদান  চলছে। এখনো বেশিরভাগ মহিলাই বাড়ির কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকে তাই ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট অর্থাৎ বর্জ্য পদার্থের সঠিক ব্যবহার নিয়েও নানান কর্মসূচি আয়োজন করা হয়েছে জাতিপুঞ্জর তরফ থেকে। সবশেষে জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষণের মেয়েদের ভূমিকা ঠিক কতখানি, সেই সম্বন্ধে সচেতন করার কাজও চলছে। সর্বোপরি পরিবেশ সুরক্ষার মাধ্যমে মেয়েদের স্বনির্ভরতা গড়ে তোলার কাজ চলছে।

পরিবেশ ও প্রকৃতি আসলে একটা সুরক্ষার চাদর। যা আমাদের জীবনকে আলোয়, যত্নে মুড়ে রাখে। মেয়েরা আজো ঘরে-বাইরে নানান সমস্যার সঙ্গে লড়াই করে, সুস্থ পরিবেশের অভাব বা প্রকৃতির স্বাস্থ্য রক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আড়ালেই থেকে যায় সাধারনত। কিন্তু এই বিষয়গুলোর প্রতি সঠিক ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি জীবনের ক্ষেত্রে ঠিক কতটা জরুরি, তা তাদের বোঝানোর প্রয়োজন। নইলে লিঙ্গ সাম্যের ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ার সম্ভাবনা প্রবল।

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...