স্মৃতি থাকা আর মুছে যাওয়ার মাঝের মুহূর্তগুলো যন্ত্রণার কথা বলে

বেলাশেষে সিনেমার আরতিকে মনে আছে? কিছু নির্দিষ্ট স্মৃতি তাকে আঁকড়ে রেখেছে। অথচ বাকি স্মৃতিগুলোর ব্যাপারে নির্লিপ্ত, উদাসীন সে। আপনজনের অস্তিত্ব, বিরহ কোনটাই তাকে আনন্দ বা দুঃখ দেয় না। নিজের ছোট্ট স্মৃতিময় জগতে বিচরণ করে সে। পরিবার অনেক চেষ্টা করে তার স্মৃতি ফেরাতে। এমনকি মেয়েবেলার মুহূর্ত ফিরিয়ে দিয়েও চেষ্টা চলতে থাকে। কিন্তু স্মৃতিরা তার কাছে উড়োমেঘের মতো। ধরা দিয়েও দেয় না। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে  স্মৃতিশক্তি হারানো বা কমে যাওয়া সেভাবে অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে তা অসুখে পরিণত হয়। আর সেই অসুখ জীবনকে অন্ধকার দৈত্যের মতো আষ্টে-পৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে। মুক্ত হওয়ার কোন উপায় থাকে না। এর পোশাকি নাম অ্যালজাইমার্স ডিজিজ। স্নায়ুঘটিত এই রোগটি মোটামুটি আমাদের কাছে পরিচিত। তবে শুধুই নামে। সমীক্ষা বলছে এই রোগ নিয়ে সচেতনতার যথেষ্ট অভাব রয়েছে এখনো। আর সেই সচেতনতা বৃদ্ধির জন্যেই প্রতি বছর ২১শে সেপ্টেম্বর বিশ্ব অ্যালজাইমার্স দিবস পালিত হয়।


ষাটোর্ধ্ব বা তার বেশি বয়সের জনসংখ্যার প্রায় ছয় শতাংশ মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হন। সমীক্ষায় পাওয়া গেছে এই তথ্য। তবে সবচেয়ে আশ্চর্য করে দিয়েছে সমীক্ষায় পাওয়া আরেক তথ্য। বিশ্বে প্রতি তিন জনের মধ্যে দুজন মানুষ এই রোগ সম্পর্কে এখনো কিছু জানেন না। বয়সের ভারে স্মৃতি নুইয়ে পড়ছে, এমনটা ভেবেই নিরুদ্বিগ্ন থাকেন সকলে। দুঃখের বিষয়, এখনো অনেকে এই রোগকে উচ্চ সামাজিক স্তরের রোগ হিসেবে মনে করেন। কিন্তু গবেষকরা বলছেন, যে কোন মানুষের এই রোগ হতে পারে। অ্যাজাইমার্স সম্পূর্ণরূপে স্নায়ুঘটিত একটি রোগ, যা মস্তিষ্কের কোষকে প্রভাবিত করে। ফলে মস্তিষ্কের কোষ শুকিয়ে যায়। যে সকল হরমোন মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কার্যকারিতা নিয়ন্ত্রণ করে, ক্ষয় হতে থাকে তার। এভাবেই নীরবে আক্রমণ করে অ্যালজাইমার্স।

বহু জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব এই রোগের শিকার হয়েছেন। মূলত এই সকল মানুষের আত্মীয়-স্বজন নিজেদের পরিবারের লোকজনের অ্যাজাইমার্সকে সর্বসমক্ষে এনেছেন। যেটুকু সচেতনতা আজ গড়ে উঠেছে, তা অনেকটাই এই সকল বিখ্যাত ব্যক্তিদের পরিবারের মানুষের ভূমিকায়। জেনে নেওয়া যাক এমন কিছু মানুষের নাম।

রোনাল রিগান- প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিগানের অ্যালজাইমার্স হয়েছিল। তাঁর স্ত্রী এই খবরটি জনসমক্ষে প্রকাশ করেছিলেন। স্বামীর অসুখ স্ত্রীর মনোবল ভেঙে দিতে পারেনি। বরং আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন স্বামীর মনোবল হয়ে ওঠার। তাঁরা অনুভব করেছেন এই সময় রোগীর কতটা প্রয়োজন হয় আপনজনের। এই রোগ সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে তারা এই খবর জনসমক্ষে প্রকাশ করেছিলেন।

রিচা হেওয়র্থ- মার্কিন অভিনেত্রী। শুরুর দিকে অল্প অল্প ভুলে যাওয়ার লক্ষণ ছিল। তাই খানিকটা অবহেলাই করেছিলেন। আসলে শুরুতে রোজকার জীবনের খুঁটিনাটি তথ্য ভুলে যেতেন এই অভিনেত্রী। পরের দিকে তা বেশ বড় আকার নেয়। বুঝেছিলেন প্রয়োজন চিকিৎসার। নিজেই চিকিৎসকের কাছে গিয়ে চিকিৎসা শুরু করেন তিনি। চিকিৎসার ফলে খানিকটা সুস্থ হয়ে সবার আগেই এই রোগের সচেতনতামূলক প্রচার করেন। চেষ্টা করেছিলেন সমাজকে এই রোগ সম্পর্কে ওয়াকিবকাল করতে।

পিটার ফ্যাক- টিভি সিরিজ খ্যাত অভিনেতা। শিকার হয়েছিলেন এই রোগের। সময়মত চিকিৎসা করিয়েছিলেন। তবে শেষ দিকে একেবারেই কিছু মনে করতে পারতেন না। তবুও নিজের এই রোগ সম্পর্কে কখনো কথা বলতে দ্বিধা বোধ করেননি এই অভিনেতা। নিজের সবচেয়ে বিখ্যাত টিভি সিরিজ নিয়ে শেষ দিকে একটি কথাও বলতে পারতেন না এই অভিনেতা। কারণ সেই আলজাইমার্স।

ইভলিন কেইস- অ্যাজাইমার্সে আক্রান্ত হয়ে সিনেমা জগতকে বিদায় জানাতে বাধ্য হয়েছিলেন। এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার আগেই লিখেছিলেন নিজের জীবনস্মৃতি। জনসমক্ষে এই রোগ নিয়ে কথা বলেছেন তিনি।

অ্যাজাইমার্স নিয়ে নানান গবেষণা আজও চলছে। মূলত হরমোনের প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণ করার উপায়-এর খোঁজ চলছে। সাম্প্রতিক একটি গবেষণা এই ক্ষেত্রে আশার আলো দেখিয়েছে। তবে তা মহিলাদের জন্যই। কয়জন বিজ্ঞানী দাবী করেছেন মহিলাদের শরীরে ইস্ট্রোজেন হরমোনের মাত্রা বাড়লে অ্যালজাইমার্স রোগের আশঙ্কা কমে। বেশ কয়েকজন মধ্যবয়স্কা মহিলার শরীরে ইস্ট্রোজেন হরমোনের মাত্রা পরীক্ষা করে দেখা গেছে যাদের শরীরে এই হরমোন বেশি তাদের স্মৃতি হারানোর সম্ভাবনা কম। আসলে ইস্ট্রোজেন হরমোন মস্তিষ্কের কোষ বিনষ্ট হওয়া আটকাতে পারে। তাই এই রোগের সম্ভাবনা কমে। বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছেন ইস্ট্রোজেন হরমোন প্রয়োগ করে অ্যালজাইমার্স রোগ থেকে মানুষের নিরাময়ের পথের খোঁজ পাওয়ার।অ্যালজাইমার্স রোগীর সম্পূর্ণ চিকিৎসার কোন উপায় এখনো পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। এই নতুন গবেষণা সেক্ষেত্রে আশার আলো।

স্মৃতি আমাদের জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান অংশ। যে মানুষরা আমাদের প্রতিদিনের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রয়েছেন তাদের কথা, সঙ্গ সবটাই বাঁচিয়ে রাখে আমাদের। অ্যালজাইমার্স নীরবে এসব কিছু কেড়ে নেয়। তবে সঠিক সময়ে এই রোগের নির্ণয় এবং সহানুভূতিশীল আপনজন এই রোগের মোক্ষম দাওয়াই বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...