ঋতুপর্ণের নারী

তাঁর জীবনের জার্নিটাই ছিল নারী স্বত্বার। তাঁর নিজের কাজ এবং ছবিতেও পুরোপুরি ছাপ ফেলেছিল সেই জার্নি।
দিনের পর দিন যায় যে ঘটনা হারিয়ে যায়, যাদের দিকে কেউ ফিরে তাকায় না, জীবনের দিকগুলোই, সেই মানুষগুলোই উঠে এসেছিল তাঁর সিনেমার পর্দায়।
কোনওদিনই আলাদা করে বলেননি তাঁর ছবি 'মেয়েদের ছবি'. কিন্তু মেয়েরাই তাঁর ছবিতে ফিরে ফিরে এসেছে গল্প হয়ে।
ঋতুপর্ণ ঘোষ থেকে দর্শকদের 'ঋতুপর্ণ' হয়ে ওঠার জার্নিটাও সেই পথেই। ছবির ভাষায় বদলে দিয়েছে মেয়েদের। পরিচালক ঋতুপর্ণ।

ritu-1


১৯৯২ সালে মুক্তি পায় ঋতুপর্ণের প্রথম চলচ্চিত্র ‘হীরের আংটি’ . তাঁর একমাত্র শিশু চলচ্চিত্র। ঠিক দুই বছর পর প্রকাশ পায় ‘উনিশে এপ্রিল’। ২০১২ সালে মুক্তি পায় মৃত্যুপূর্ব তাঁর শেষ চলচ্চিত্র ‘চিত্রাঙ্গদা’। সময় দুই দশক। ছবির সংখ্যা ১৯. তার মধ্যে ১২ টি ছবিতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার অর্জন।

সিনেমায় বারবার ফিরিয়ে এনেছেন মুক্তিমুখীন নারী চরিত্ররা। তারা উঠে এসেছিল জীবন থেকে। তারা ছবিতে হাসত। কাঁদত। যে রাগ-ঝগড়া-অভিমান-আদরে আগলে রাখত সংসার। আবার ঝলসেও উঠেছে বিদ্যুৎলতা হয়ে।
'উনিশে এপ্রিল', ' বাড়ীওয়ালী', 'দহন', 'চোখের বালি', 'সব চরিত্র কাল্পনিক', ' দোসর' সব ছবিতেই মেয়েরা হয়ে উঠেছে মেইন প্রোটাগনিস্ট। তারা মুক্ত। স্বাধীন। স্বাধীন সত্ত্বা হয়ে ওঠার সংগ্রাম চালিয়ে যায়।
সময় যত এগিয়েছে নিজেকে ভেঙেছেন ঋতুপর্ণ। বদলে বদলে গিয়েছে ছবির ভাষা। চরিত্ররা কখনও মা, কখন মেয়ে, কখনও স্ত্রী, কখনও স্বাধীনচেতা সাবলম্বী আধুনিক আবার কখনও ইচ্ছে-নারী।

rritu-2
অনেক ক্ষেত্রেই তাঁর ছবিতে বিপরীত নারী চরিত্রদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছেন। ভিন্ন ভাষ্য তৈরী হয়েছে ছবিতে।
'উনিশে এপ্রিল', মা-মেয়ের গল্প। আপাত দৃষ্টিতে দেখলে মনে হবে মা আর মেয়ের অভিমানের গল্প। খোলস সরালেই অন্য দেখা। যেখানেই দুই নারীই নিজেদের একক ভাবে প্ৰতিষ্ঠা করতে গিয়ে স্বাবলম্বী হতে গিয়ে তাদের পুরুষ সম্পর্কের ইগোতে। দুই প্রজন্ম। সময় আলাদা। প্রেক্ষাপট আলাদা, কিন্তু টানাপোড়েন একই। কিন্তু ঋতুপর্ণ তাদের উত্তরণ ঘটান। নিজেদের মুক্ত আকাশে। শেষ পর্যন্ত নিজের সত্ত্বাতেই উড়ান দেয় তারা।
' চোখের বালি', বিনোদিনী আর আশালতার গল্প। একজন বাল্য বিধবা। পরাশ্রিতা। অন্যজন ধনী বাড়ির আদরিনী বধূ। একজন সহজ সরল অন্যজন ক্ষুরধার। দুজনকেই পুরুষ আর সংসারে ঠকতে হয়। একজন অবোধে মেনে নেয়, অন্যজন আগুনে।
'অন্তর মহলের' ছোট বউ পর্দাসীনা বধূ. কিন্তু মৃত্যু দিয়ে প্রতিবাদ লিখে যায়।
ঋতুপর্ণের কেরিয়ারের একেবারে শুরুর দিকের ছবি ' দহন'. কলকাতার বুকেই ঘটা সত্যি ঘটার ভিত্তিতে সেই ছবি। মূল কাহিনী সুচিত্রা ভট্টাচার্য। এই ছবি রোমিতা আর ঝিনুকের গল্প। একজন গৃহবধূ আর অন্যজন শিক্ষিকা। ঘর- আর বার দুই দুনিয়াতাই দাহ্য হয় তারা। বিচার চেয়ে কন্ঠ আবদ্ধ। রোমিতার ভূমিকায় ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত এবং ঝিনুকের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন ইন্দ্রানী হালদার। দুজনেই জাতীয় পুরস্কার সূত্রে।
সত্যজিৎ রায় এবং শ্যাম বেনেগলের লিগ্যাসির বাহক ছিলেন ঋতুপর্ণ। আর্ট হাউস ফিল্মে ভারতীয় মেয়েদের ভাষা তৈরী করেছিলেন। এদেশের সমাজ ব্যবস্থায় মেয়েদের অবস্থা ছবির বিষয় হয়ে ঘুরে ফিরে এসেছে।

ritu-3
মেয়েদের একান্ত ঘরোয়া জীবন। তাদের ব্যক্তিগত পরিসর। বেঁচে থাকা। সম্পর্ক যাপন। জটিলতা। আবেগ। সবই যেন আসলে এক নিরুচ্চার সংগ্রাম। গল্পগুলোও চেনা জানা। বাকিরা চিনতে পারে না। ঋতুপর্ণ পেরেছিলেন।
আসলে ঋতুপর্ণ তাঁর ছবিতে ' ফেমিনিস্ট স্ট্রাগল' কে মুড়েছিলেন মমতায়। পরিবেশন করা ছিলেন শহুরে দর্শকদের বোধগম্য করে। ছবি দেখতে দেখতে রেগে উঠতে পারেন দর্শকরা, কিন্তু ক্লান্তি আসে না।
তাঁর গদ্যের ভাষার মতোই ঝরঝরে ছবির ভাষা। সেই টানেই দর্শকরা ফিরতেন ছবির সামনে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...