সমতল পেরিয়ে পাহাড়ের ডাকে সাড়া দিতে গেলেই পথে পড়ে এক দুয়ার। সেই দুয়ারে থেমে, গাড়ি বদল করে তবে চড়তে হয় পাহাড়ে। এই দরজা থেকে বদলাতে থাকে বাতাসের গন্ধ। হালকা-পলকা বাতাস ভরে নেওয়া যায় হৃদয় আর মস্তিষ্কে। সেই দরজার নাম শিলিগুড়ি। বাঙালির পাহাড় যাওয়ার দরজা।
শুধু পাহাড় নয় শিলিগুড়ি উত্তর-পূর্ব ভারতের অন্যতম প্রধান প্রবেশদ্বার। পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় বৃহত্তম মেট্রোপলিটন সিটি শিলিগুড়ি। ১১১ বছরের পুরনো এই শহর এক সময় যুক্ত ছিল কার্শিয়াং-এর সঙ্গে। ১৯০৭ সালের ২৫ মে ব্রিটিশরা শিলিগুড়িকে আলাদা মহকুমা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। তারও চার বছর আগে মানে ১৯০৩ সালে তৈরী হয়েছিল শিলিগুড়ি থানা।
ব্রিটিশ শাসকদের ছুটি কাটানোর জায়গা ছিল দার্জিলিং। প্রমোদাবাসও গড়ে উঠছিল সেখানে। দার্জিলিং-এর সহদোরা শহর হিসেবে ক্রমশ ইংরেজদের কাছে গুরুত্ব বাড়ছিল মহানন্দা ছোঁয়া শিলিগুড়ির।
উত্তর-পূর্বের ৭ টি রাজ্য সরাসরি জড়িয়ে আছে করিডোর শিলিগুড়ির সঙ্গে। বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান, চীন- চারটি আন্তর্জাতিক সীমানা ছুঁয়ে আছে।
‘শিলিগুড়ি’ নামেরও আলাদা মানে আছে। শৈলেন দেবনাথের মতে, "শিলিগুড়ি" নামটির অর্থ নুড়িপাথরের ঢিবি। ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত এই অঞ্চলটি পরিচিত ছিল "শিলচাগুড়ি" নামে। বিভিন্ন নথিপত্রতেও ‘শিলচাগুড়ি’ নামটির উল্লেখ পাওয়া গিয়েছে। শিলচাগুড়িই পরে শিলিগুড়ি হয়ে যায়।
এখন শুনতে আশ্চর্য লাগলেও এক সময় কিন্তু এই অঞ্চল দোলকা বনে ঢাকা ছিল। সেই বনে নাকি ঘুরে বেড়াত চিতা, হাতি আর নানারকম বন্যপ্রাণী। ষোড়শ শতাব্দীতে এই অঞ্চল কামতা রাজত্বের অধীনে ছিল। আঠারো শতাব্দীতে সিকিমের অধীন এবং পরে নেপাল। শিলিগুড়ির ভূমি ছিল খুব উর্বর আবাদের টানেই কিরাতি আর নেপালি মানুষজন এসে এখানে বসতি শুরু করে। মহানন্দার জলপথ ধরে ব্যবসা চালাত সিকিম আর ভুটানের ভূমিপুত্ররা। ১৭৫৭-এ পলাশির পতনের পর ফের রাজ-বদল আসে শিলিগুড়ির ভাগ্যে।
১৮১৫-তে ব্রিটিশ আর নেপালের রাজার মধ্যে সগৌলের চুক্তি হয়। ১৮৬৫তে দার্জিলিং অধিকার করে ইংরেজরা। তখন শিলিগুড়িকে নতুন করে গড়ে তোলার কাজেও নজর দেওয়া হয়।
১৮৭৮-এ শিলিগুড়িতে তৈরী হয় শিলিগুড়ি স্টেশন। তার আগে পর্যন্ত শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং যাওয়ার একমাত্র রাস্তা ছিল গ্যাঞ্জেস রোড। তবে এই রাস্তা ইংরেজরা নয়, তৈরী করেছিলেন বর্ধমানের মহারাজ। পরে তৈরী হয় হিলকার্ট রোড। ১৯৬০ সালে শিলিগুড়িতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ত্রিশক্তি কর্পস-এর দফতর ছিল।
আজকের শিলিগুড়ি শহরের সঙ্গে পুরনো শিলিগুড়ি শহরের বিশেষ মিল নেই। এক সময় হিলকার্ট রোডের পাশেই বর্ধমান রোডের কাছে ছিল হাতিশালা। শালকাঠের বিশাল খুঁটিতে বাঁধা থাকত হাতি। হাতি দেখতে ভিড় জমত হাতি শালায়।
শিলিগুড়িতে রেলপথ বসলে হিলকার্ট রোড দিয়ে চলে দার্জিলিং হিমালয়ান ন্যারোগেজ লাইন। সোজা কালিম্পং পর্যন্ত। পরে অবশ্য বদলে যায় সেই পথ। হিলকার্ট রোড স্টেশন নাম বদলে হয় হাসমি চক। বিশের দশকে শিলিগুড়ি কলকাতা ব্রডগেজ লাইনে জুড়ে যায়।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর শিলিগুড়ি হয়ে ওঠে ‘শিলিগুড়ি করিডোর’। ১৯৯৪ সালে ভারত এবং চীনের সঙ্গে নাথুলা পাস চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং তার পরেই শিলিগুড়ির গুরুত্ব আরও বৃদ্ধি পায়। শিলিগুড়ি হয়ে ওঠে আন্তর্জাতিক পরিবহণ হাব বলা চলে।
শিলিগুড়ি বাঙালির খুব ভালোবাসার শহর। এই নাম কানে এলেই নাকে ভেসে আসে চাপাতার গন্ধ। চা বাগানে হলুদ রোদের আহ্লাদ আর বেড়াতে যাওয়ার নেশা। কিন্তু বাদ পড়ে যায় শহরের ইতিহাসটুকু।