কাঁদুনে শিবের কান্না-কারণ

ত্রিলোকে ব্যাপ্ত হয়ে সবাইকে সচকিত করে তুলল একটি শিশুর কান্না। সেই কান্না তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে দেবতাদেরও স্থির থাকতে দিল না। তাঁরা সেই কান্নার উৎস সন্ধান করতে করতে হাজির হলেন শেষে শিবলোকে। সাক্ষী হলেন শিবের নতুন এক লীলার। সবাই এসে অবাক হয়ে দেখলেন, শিব শিশুরূপে উচ্চৈঃস্বরে কাঁদছেন! দেবতাদের প্রায় সকলেই শিবের এই লীলার মর্ম কিছুই না-বুঝে কেমন যেন হতভম্ব হয়ে গেলেন। 

তখন এগিয়ে এলেন নারায়ণ। তিনি গিয়ে ক্রন্দনরত শিশু শিবকে জিজ্ঞেস করলেন, 'হে শিব, তুমি এমন করে শিশুর মতো কাঁদছ কেন? কাঁদতে কাঁদতে শিশুর আবদারে শিব বললেন, 'আমায় তুমি সুন্দর একটি নাম দাও না নারায়ণ! একটিও মনের মতো নাম নেই যে আমার!' এই কথা শুনে নারায়ণ স্মিত হাসলেন। বললেন, 'বেশ। তুমি তো এখন রোদন করছ, তাই তোমার নাম দিলাম, 'রুদ্র'। নামটা সুন্দর না?' এতে শিবের কান্না আরও বেড়ে গেল। তিনি অবুঝ শিশুর মতো মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, 'না না না, এর চেয়েও ভালো নাম তুমি দিতে পারো। আরও আরও ভালো নাম আমায় দাও!' নারায়ণ আবার স্মিত হেসে বললেন, 'আচ্ছা বেশ, তোমার নাম দিচ্ছি তাহলে 'সর্ব', 'শর্ব' আর 'উগ্র'। এবার খুশি তো?' কিন্তু না, তাতেও শিশু ভোলানাথের মন ভরল না। তিনি কাঁদতে কাঁদতে সেই একইভাবে অবুঝের মতো বললেন, 'না, না, না, আমায় আরও ভালো নাম দাও!' 

এবার বেশ ভাবনায় পড়ে গেলেন নারায়ণ। আকাশ পাতাল ভেবেও বুঝতে পারলেন না কোন নামে শিব তুষ্ট হবেন, কোন নাম পাওয়ার অভিলাষ শিবের মনে! ভাবতে ভাবতেই একসময় তাঁর মাথায় খেলে গেল যেন উপলব্ধির বিদ্যুৎ! পেয়ে গেলেন আশুতোষের তুষ্টির সন্ধান। তিনি স্বভাবসুলভ স্মিত হেসে বললেন, 'হে শিব, তুমি সকল দেবতাদের মধ্যে প্রধান, তাই তোমার নাম দিলাম, 'মহাদেব'! এবার তুমি খুশি তো?' হ্যাঁ, এইবার শিবের মনে ধরল নাম। থেমে গেল তাঁর কান্না। ফুটে উঠল তাঁর মুখে প্রশান্তির হাসি। হ্যাঁ, এই নাম, এই স্বীকৃতিই তো তিনি চাইছিলেন। দেবাদিদেব মহাদেবকে তুষ্ট করতে পেরে নারায়ণের সঙ্গে সমস্ত দেবতারা যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন এবার। তাঁরা মহাদেবের বন্দনা করে বিদায় নিলেন।

'মহাদেব' নামটি শিবের অত্যন্ত প্রিয় হলেও 'রুদ্র', 'সর্ব', 'শর্ব', 'উগ্র' প্রতিটি নামই যেহেতু নারায়ণের দেওয়া; সেহেতু এই নামগুলোও শিবের ভূষণ, শিবের কাছে সম্মানের। এই সমস্ত নামের মাহাত্ম্য শিবের আচরণের সঙ্গে সেই থেকে তাই জুড়ে রইল। রুদ্ররূপে শিব যেন আকাশপাতাল কাঁপানো ভীষণ কান্নার মতোই সংহারের এক মূর্তি। রাজা, মহারাজা, ধনী, দরিদ্র, পাপীতাপী, এমনকি দেবতারাও তাঁর সেই রুদ্ররূপের কোপ থেকে রক্ষা পান না, তাই তিনি এই রূপে 'পরমেশ্বর'। 'উগ্র' নামেও তাঁর এই স্বভাবেরই প্রকাশ। আর 'সর্ব' ও 'শর্ব'- নাম দুটির মধ্যেও আছে অগ্নির মতো মানুষের সমস্ত কর্মের অহংকার ছাই করে ফেলার ইঙ্গিত। তাই চিতার ছাইয়ের ওপর বসে সাধক যদি মহাদেবের এই নাম জপ করেন; তাহলে তিনি মহাদেবের প্রিয় হয়ে ওঠেন। আর যেখানে ভক্তের স্থান, সেখানেই ভগবানের বাস। তাই শ্মশানে চিতাভস্মের মাঝে মহাদেবেরও বাস ও বিহার। 

আসলে, মহাদেবের উদ্দিষ্ট 'চিতা' বা 'শ্মশান' শুধু লৌকিক অর্থেই সীমাবদ্ধ নয়, প্রতীকের মধ্য দিয়ে তা গভীর ব্যঞ্জনাবাহী। যে-মানুষ বা ভক্ত তাঁর অন্তরের সমস্ত কামনা-বাসনা, অহং ও আত্মপরবোধ পুড়িয়ে চিতার আগুনের মতো নষ্ট করে দিতে পারেন, তাঁর মধ্যেই মহাদেব বাস করেন। 'শিব পুরাণ'-এ মহাদেবের শ্মশানবাসের লৌকিক ও আধ্যাত্মিক--এই দুটো দিকই এভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।


গল্পটির উৎস : শ্রীকৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস রচিত, 'শিব পুরাণ'।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...