সতীপীঠঃ আকাশিগঙ্গায় হাজার বছরেরও প্রাচীন পর্বতময় তীর্থে রয়েছেন বিপদনাশিনী ‘মা মালিনী’

অরুণাচল প্রদেশের আকাশিগঙ্গার সুপ্রাচীন সিদ্ধ শক্তিপীঠ নিয়ে বাংলায় তেমন একটা আলোচনা নেই, হয়ও না। অথচ বাংলার বাইরের মানুষের কাছে এই পীঠ খুব বিখ্যাত। একান্ন সতীপীঠের অন্যতম এক পীঠ হিসেবে স্বীকৃত। কেননা, পৌরাণিক কিংবদন্তি অনুসারে, ভগবান বিষ্ণুর সুদর্শনে কর্তিত হয়ে এখানেই পতিত হয়েছিল দেবী সতীর মস্তক বা মাথা।

অরুণাচল প্রদেশের পশ্চিম সিয়াং জেলার মালিনীথান শহর থেকে মাত্র বারো কিলোমিটার দূরে এই সিদ্ধপীঠ আকাশিগঙ্গা অবস্থিত। চারিদিকে গাঢ় সবুজের চাদর গায়ে দিয়ে কুয়াশা আর মেঘমাখা পাহাড়েরা সারি বেঁধে সেই প্রকৃতির অপরূপ সজ্জা থেকে অফুরান সৌন্দর্য বিলিয়ে চলেছে। এদের মাঝখানে রয়েছে আরও অপরূপ একটি ছোট্ট পাহাড়। এই পাহাড়ের দু’পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে ঘাগরা আর ঘাই নদী। তারাও আপন আপন সৌন্দর্য উজাড় করে দিয়ে এই পবিত্র স্থানটিকে আরও মোহময় করে তুলেছে।

আকাশিগঙ্গা যে মালিনীথানে অবস্থিত, সেই সমগ্র মালিনীথানকেই ভক্তজন শিব-দুর্গার আবাসভূমি বলে থাকেন। কেন বলে থাকেন, তাই নিয়ে একটি পৌরাণিক কিংবদন্তি প্রচলিত হয়েছে। সেটি শুনলেই আপনারা বুঝতে পারবেন যে, স্থানটির নাম কেন ‘মালিনীথান’ হল, কেন এই স্থানের আকাশিগঙ্গায় শক্তিপীঠ তথা সতীপীঠ সিদ্ধপীঠ হয়ে উঠল। কিংবদন্তিটি এবার শুনুনঃ

পৌরাণিককালে অরুণাচলে ভীষ্মকানগর নামের এক রাজ্য ছিল। সেখানকার রাজা ছিলেন ভীষ্মক। ভীষ্মকের এক কন্যার নাম ছিল রুক্মিণী। রুক্মিণী বিবাহযোগ্যা হয়ে উঠলে রাজা তাঁর স্বয়ংবরসভার আয়োজন করলেন। কিন্তু ভগবান কৃষ্ণ আগেই রুক্মিণীকে হরণ করলেন। তাঁকে নিয়ে চললেন দ্বারকার পথে। পথে পড়ল রাজ্যেরই এক অপরূপ পর্বতময় প্রদেশ আকাশিগঙ্গা। রুক্মিণীর ইচ্ছায় সেখানে রথ থামালেন কৃষ্ণ। তাঁদের আসতে দেখে পাহাড়ের আবাস থেকে বেরিয়ে এলেন দেবাদিদেব মহাদেব ও তাঁর পত্নী পার্বতী। শ্রীকৃষ্ণ ও রুক্মিণী তাঁদের প্রণাম করলেন, আশীর্বাদ নিলেন। মহাদেব-পার্বতীও তাঁদের আতিথ্য নিতে অনুরোধ করলেন।

শ্রীকৃষ্ণ ও রুক্মিণী সানন্দে সেই অনুরোধ গ্রহণ করে মহাদেব-পার্বতীর সন্নিধানে আনন্দে দিনযাপন করতে লাগলেন। তারই মাঝে বসন্ত এলো, চারিদিকের প্রকৃতি হরেক ফুলের সাজে সেজে উঠল। কোকিলের সুমিষ্ট কুহু রবে চরাচর ভরে উঠল। এমন চমৎকার আবহে শ্রীকৃষ্ণ-রুক্মিণীরও মন উচাটন হল, উতলা হল। তাঁদের উভয়ের মনের এই গতি বুঝতে পেরে পার্বতী মালিনীর মতো নিজের হাতে ফুল তুলে মালা গাঁথলেন। তারপর শিবের পৌরহিত্যে উভয়ের বিয়ে দিলেন। এই বিবাহের পর অল্পকিছুদিন শিবের এই আবাসে অতিবাহিত করে শ্রীকৃষ্ণ-রুক্মিণী দ্বারকায় ফিরে গেলেন।

কিংবদন্তি-কাহিনি থেকে এটা স্পষ্ট যে আকাশিগঙ্গা কৈলাসের মতোই শিব-পার্বতীর আর-একটি পবিত্র বাসস্থান। তার ওপর এই স্থান শ্রীকৃষ্ণ ও মাতা রুক্মিণীর পদধূলিধন্য; এই স্থান তাঁদের বিবাহক্ষেত্র। তাঁদের বিবাহ উপলক্ষে মাতা পার্বতী মালিনীর ভূমিকা নিয়ে নিজের হাতে মালা গেঁথেছিলেন; তাই দেবী এখানে প্রাচীন সময় থেকেই ভক্তদের ভালোবাসায় ‘মালিনী’ নামে পূজিতা হতে শুরু করেন। তাঁরাই এই সমসগ্র পার্বত্যময় প্রদেশের নাম দেবীর নামে মালিনীর স্থান বা ‘মালিনীথান’ বলে অভিহিত করতে শুরু করেন। ধীরে ধীরে সকলের কাছেই স্থানটি ‘মালিনীথান’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে।

মালিনীথানের আকাশগঙ্গার দেবীমন্দিরটি ভূমি থেকে প্রায় দুশো ফুট উচ্চতায় পাহাড়ের গায়ে অবস্থিত। সেখানে ওঠার কংক্রিটের সিঁড়ি নতুন করে বানানো হয়েছে। দেবীর মন্দিরটি খুব বেশি পুরনো নয়। ১৯৬৮-৬৯ সালে তৈরি। তবে দেবীস্থানটি হাজারেরও বেশি বছরের পুরনো। আসলে, এখানে প্রাচীন প্রত্নবস্তু থাকার সম্ভাবনা জানতে পেরে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগ ১৯৬৮ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বেশ কয়েক বার খনন করান। এই খননের ফলে বিভিন্ন সময়ে মাটির নীচ থেকে পুরাতন মন্দিরের বেশ কয়েকটি কাঠামো আবিষ্কৃত হয়। তা থেকে বোঝা যায় যে, এখানে দেবী শক্তির মন্দিরই প্রধান ছিল, কিন্তু দেবী এখানে একা ছিলেন না। তাঁর মন্দির ঘিরে আরও কয়েকজন দেবদেবীর পৃথক পৃথক মন্দির ছিল। মন্দিরগুলো গ্রানাইট পাথর দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল। বিভিন্ন সময়ের এই খননে মন্দিরের বিভিন্ন অংশের অপূর্ব অলংকরণসমৃদ্ধ প্রচুর স্তম্ভ যেমন পাওয়া গেছে; তেমনই পাওয়া গেছে অসংখ্য দেবদেবী, তাঁদের বাহন প্রভৃতির পূর্ণ এবং ভগ্ন মূর্তি। তার মধ্যে সূর্য, কার্তিক, ইন্দ্র, শিব, নন্দী, হাতি, সিংহ, দশভূজা দুর্গা, গণেশ, যক্ষ প্রভৃতির মূর্তি উল্লেখযোগ্য। কিন্তু এই সমস্ত প্রত্নসামগ্রী থেকে এমন কিছু পাওয়া যায়নি, যা থেকে বোঝা যায় যে, ঠিক কবে কে এই মন্দিরগুলো নির্মাণ করিয়েছিলেন। শুধু এটুকু বোঝা গেছে যে, কয়েকশো বছর আগে ভূমিকম্পের মতো কোন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলেই এই দেবস্থানটি বিনষ্ট হয়ে গিয়েছিল, হারিয়ে গিয়েছিল অপূর্ব কারুকাজশোভিত সুপ্রাচীন মন্দিরগুলি। নতুন মন্দিরের প্রাঙ্গণে পুরাতত্ত্ববিভাগের সংগ্রহশালা হয়েছে এখন; উদ্ধার হওয়া সমস্ত প্রত্নবস্তুই এখন সকলের সম্মুখে সেখানে সাজানো রয়েছে। তা দেখে কল্পনাপ্রবণ ভক্তজন প্রাচীন হারিয়ে যাওয়া দেবীমন্দিরের অপার সৌন্দর্যের কিছুটা হলেও অনুভব করতে পারেন।

খননের আগে কয়েকশো বছর ধরে ভগ্নস্তূপের ওপর প্রাচীন থানে দেবী দশভূজা দুর্গা সুপ্রাচীন মূর্তিতে ভক্তদের দ্বারা পূজিতা হতেন। উৎখননের আগে ভক্তদের পুজোর সুবিধের জন্য আলাদা একটি মন্দির নির্মাণ করিয়ে দেওয়া হয়। ওড়িশাশৈলীতে পুরীর জগন্নাথদেবের মন্দিরের আদলে এই মন্দির নির্মাণ করানো হয়। তারপর সেখানে দেবীকে স্থাপন করা হয়। সেই থেকে দেবী এই মন্দিরেই পূজিতা হয়ে আসছেন। এই নবনির্মিত শাক্তমন্দিরের বাইরের রঙ লাল।

গর্ভগৃহে রত্নবেদিতে সেই প্রতিষ্ঠিত প্রাচীন প্রস্তরমূর্তিতে এখনও পূজিতা হচ্ছেন দেবী দুর্গা। ভক্তজনের কাছে তিনিই ‘দেবীমা মালিনী’। তাঁর দশটি হাত। দশ হাতে নানাবিধ আয়ুধ। দেবী অসুরদলনী, শান্তিদায়িনী, বিপদনাশিনী, আশ্রয়দাত্রী মা। প্রসন্নময়ী করুণাময়ী। ভক্তজন তাঁর চরণে নত হয়ে আশ্রয় চান, শান্তি চান আর সংসারের সমস্ত পাপ কলুষ থেকে চান মুক্তি।             

আকাশিগঙ্গা দেবীমন্দিরের একশো গজ দূরেই রয়েছে একটি পবিত্র প্রাকৃতিক কুণ্ড। কুণ্ডের ভেতরে নেমে গেছে ঘোরানো পাথরের বিস্তৃত সিঁড়ি। কুণ্ডের জলে আলোর প্রতিফলন এমনভাবে হয়, যার ফলে ওপর থেকে দেখলে কুণ্ডের ভেতরে কোন চকচকে বস্তু আছে বলে বিভ্রম হয়। সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে জলস্তরের কাছাকাছি গেলে সেই প্রতিফলন আর দেখা যায় না; যেন মনে হয় চকচকে বস্তুটির কাছাকাছি যাওয়ার কারণেই সেটি অদৃশ্য হয়ে গেছে! এই বিষয়টিকে প্রাচীন সময়ে অনেকেই কোন অলৌকিক ব্যাপার বলে মনে করতেন। বর্তমানে অনেকেই সচেতন হয়েছেন, বিজ্ঞানমনস্ক হয়েছেন; তাঁরা এই বিভ্রমের সাক্ষী হয়ে আনন্দ পান, প্রকৃতির এমন খেয়ালী কারিগরীর কথা ভেবে আশ্চর্য হন। সাধারণ ভক্তজন অবশ্য আজও এই কুণ্ডকে অলৌকিক কুণ্ড বলে মনে করেন এবং কুণ্ডের জলকে অত্যন্ত পবিত্র ও পাপনাশী বলে মনে করেন; মনে করেন যে, এই কুণ্ডের জলের অনেক রকম রোগ সারিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা আছে। তাই এই কুণ্ডের জলে স্নান করে তারপর তাঁরা দেবীর পুজো দেন। প্রতিবছর মকর সংক্রান্তির সময় এই কুণ্ডের জলে স্নান করে পাপমুক্ত হতে এখানে আসেন হাজার হাজার ভক্ত।

কামাখ্যার পরই ভক্তজনের কাছে সিদ্ধপীঠ হিসেবে এই আকাশিগঙ্গার স্থান। মন্দিরের আশেপাশে অসংখ্য সাধু, সন্ত, সাধকের আস্তানা; সাধনক্ষেত্র। নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত দেবীর মন্দিরে প্রচুর মানুষের ভিড় হয়। সকাল ছ’টা থেকে রাত্তির ন’টা অব্দি দেবীদর্শন করা যায়। দেওয়া যায় পুজো। এই মন্দিরে শারদীয়া দুর্গাপুজো যেমন জাঁকজমকের সঙ্গে উদযাপিত হয়, তেমনই বাসন্তী পুজোও খুব ধূমধামের সঙ্গে পালিত হয়। মকর সংক্রান্তির সময় প্রতিবছর দেবীর মন্দিরের নিকটের এক প্রশস্ত প্রাঙ্গণে অপূর্ব সুন্দর এক মেলা বসে। সাধারণের কাছে এই মেলা ‘মালিনী মেলা’ নামে বিখ্যাত। সারা ভারতের ভক্তজনের কাছে কিন্তু এই মেলার আকর্ষণ প্রভূত। কেননা, নানান রকমের নাগরদোলা, হরেক রকমের স্থানীয় খাবার, বিভিন্ন ধরণের কুটিরশিল্পের সম্ভার এই মেলার প্রতি সকলকে আকৃষ্ট করে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...