রাবণ রামচন্দ্রের স্ত্রী সীতাকে হরণ করার পর রামচন্দ্র অত্যন্ত ভেঙে পড়েন। প্রিয় পত্নীকে হারিয়ে তিনি শোকে মূহ্যমান, সেইসময় দেবর্ষি নারদ এসে তাঁকে বলেন,‘ সীতা দেবীর পাশে সকল দেবতারা আছেন, স্বয়ং ইন্দ্র প্রতিদিন তাঁকে কামধেনু গাইয়ের দুধ দান করছেন খাওয়ার জন্য। তাই সীতা দেবীকে নিয়ে মনের মধ্যে চলা সকল দুঃশ্চিন্তা দূরে সরিয়ে এখন আপনি সীতা দেবীকে উদ্ধার করার যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নিন। দেবী সীতাকে উদ্ধার করতে ও রাবণকে বধ করবার জন্য শারীরিক ও মানসিক শক্তির পাশাপাশি প্রয়োজন দৈবিক আশীর্বাদ। সেই আশীর্বাদ প্রাপ্ত হওয়ার জন্য রাঘব আপনার অবশ্যই দেবী দুর্গার আরাধনা করা উচিত।’
দেবী ভাগবতের তৃতীয় স্কন্ধে নারদ দেবী পুজোর মাহাত্ম্যর কথা বর্ণনা করে বলেন, দেবীর আরাধনা করলে সকল মনস্কামনা পূর্ণ হয়- এই বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। সকল মুনি ঋষি থেকে শুরু করে দেবরাজ ইন্দ্র পর্যন্ত দেবী মহামায়ার আরাধনা করে তার কৃপা লাভ করেই শত্রু দমন করে বিজয়ী হয়েছেন, তাই সেই দেবীর কৃপা লাভ করলে রামচন্দ্রও অতি সহজেই নিজ শত্রু রাবণকে বধ করতে পারবেন। তাই রামচন্দ্রের ভক্তিযুক্ত মনে দেবীর পুজো করা উচিত।
দেবর্ষি নারদের কথায়, “ রঘুকুলতিলক! পবিত্র ও প্রশস্ত পণ্ড দ্বারা দেবীর বলি প্রদান ও জপ এবং জপের দশাংশ হোম করিলে নিশ্চয়ই সীতার সমুদ্ধারে সমর্থ হইবেন। পূর্ব্বে বিষ্ণু, ত্রিলোচন ও পদ্মাসন, এবং স্বর্গস্থিত দেবরাজও এই ব্রতের অনুষ্ঠান করিয়াছিলেন। অতএব হে রাঘব! সুখী ব্যক্তির বিশেষতঃ কণ্ঠসঙ্কটে নিপতিত পুরুষগণের এই কল্যাণকর ব্রতের অনুষ্ঠান করা একান্তই কর্তব্য। বিশ্বামিত্র, ভৃগু, বশিষ্ঠ ও কাশ্যপ ইহাঁরা সকলেই এই ব্রতের আচরণ করিয়াছিলেন। সোম সুরগুরুর ভার্য্যা তারারে হরণ করিলে, তিনিও এই মহাব্রতের অনুষ্ঠান করিয়া স্বীয় পত্নী প্রাপ্ত হইয়াছিলেন, অতএব রাজেন্দ্র! আপনিও রাবণ বধের নিমিত্ত এই ব্রতের আচরণ করুন। হে মহামতে! ইন্দ্র বৃত্রবিনাশের নিমিত্ত ত্রিলোচন ত্রিপুরবিনাশার্থ এবং নারায়ণ মধুকৈটভবিনাশের নিমিত্ত পূর্ব্বে এই ব্রতের অনুষ্ঠান করিয়াছিলেন, অতএব আপনিও সমাহিতচিত্তে বিধিপূর্ব্বক এই ব্রতানুষ্ঠানে দৃঢ়সঙ্কল্প হউন।”
রামচন্দ্র তখন নারদকে দেবীর কথা জিজ্ঞাসা করেন। নারদ তখন দেবীর মাহাত্ম্য বর্ণনা করেন। রামের এই জিঞ্জাসা প্রসঙ্গে দেবী ভাগবতে বলা হয়েছে, “রাম কহিলেন, জ্ঞাননিধে! সেই দেবী কে? তাঁহার প্রভাব কিরূপ, কোথা হইতে তিনি জন্মগ্রহণ করিয়াছেন, তাঁহার নাম কি, সেই ব্রতই বা কি প্রকার? আপনি করুণাবিতরণ পূর্ব্বক তৎসমস্তই বিস্তারিত রূপে আমার নিকট কীর্তন করুন।”
রামচন্দ্রের কৌতুহল নিবারণ করতে দেবী যে সনাতনী আদ্যা শক্তি এবং দেবী থেকে সমস্ত শক্তি উৎপন্ন হলেও দেবী নিজে নিত্যা ও পরমাপ্রকৃতি এই বিষয়টি নারদ রামচন্দ্রকে বুঝিয়ে বলেন। দেবীভাগবত অনুযায়ী, “নারদ কহিলেন, রাঘব। শ্রবণ করুন, সেই দেবী নিত্যা ও সনাতনী আদ্যাশক্তি, তাঁহার পুজা করিলে তিনি সকল দুঃখ দূর করিয়া সমস্ত কামনা সিদ্ধ করিয়া থাকেন। তিনি ব্রহ্মাদি অখিল জীবগণের কারণ, তাঁহার শক্তি ব্যতিরেকে কোন ব্যক্তি নড়িতে চড়িতেও সমর্থ হয় না। সেই পরাৎপরা শিবাদেবীই বিষ্ণুর পালনশক্তি, বিধাতার সৃষ্টিশক্তি, এবং মহেশ্বরের সংহারশক্তি। এই অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড মণ্ডলে যে কোনও স্থানে যে কিছু নম্বর ও নিত্য বস্তু বিদ্যমান আছে, তিনিই তৎসমুদায়ের শক্তি; অতএব তাঁহার উৎপত্তি আর কোথা হইতে হইবে? তাঁহার উৎপত্তির কারণ ব্রহ্মা নহেন, বিষ্ণু নহেন, রুদ্র নহেন, সূর্য্য নহেন, ইন্দ্রাদি সুরগণ নহেন, ধরা নহেন, ধরাধরও নহেন, অতএব তিনিই নির্গুণা কৈবল্যরূপিণী পূর্ণা প্রকৃতি, তিনি প্রলয়কালে পরমপুরুষের সহিত মিলিত হইয়া বিহার করিয়া থাকেন। তিনিই অবার সগুণা হইয়া প্রথমে ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বরাদির সৃষ্টি করিয়া তাঁহাদিগকে সমস্ত শক্তি প্রদান পূর্ব্বক এই ভুবনত্রয়ের সৃষ্টি করিয়া থাকেন। তিনিই পরমাবিদ্যা বেদাদ্যা ও বেদকারিণী, জীবগণ তাঁহার স্বরূপ জানিতে পারিলে সংসারবন্ধন হইতে মুক্তি লাভ করিতে সমর্থ হয়। ব্রহ্মাদি-দেবগণ, গুণ ও কৰ্ম্ম অনুসারে তাঁহার অসংখ্য নাম কল্পনা করিয়া থাকেন। তাহা আমি বর্ণন করিতে সমর্থ নহি। হে রঘুনন্দন! বিবিধ স্বরবর্ণ সংযোজিত অকারাদি ক্ষকারান্ত বর্ণ সমূহ দ্বারা তাঁহার অসংখ্য নাম বিরচিত হইয়াছে।”
রামচন্দ্র এরপর নারদের কাছ থেকে দেবীর পূজা বিষয়ক সমস্ত বিধি জেনে নিয়ে দেবীর পূজা করতে শুরু করলেন। রামচন্দ্র ও লক্ষণ দুই ভাই মিলে সমস্ত বিধি মেনে রামচন্দ্র উপোস করে সেই মহা ব্রতের অনুষ্ঠান করলেন, বিধিপূর্বক হোম, বলিদান ও পুজো দিলেন। এরপর অষ্টমীর মহারাত্রিতে নারদের বলা কথা অনুযায়ী দেবীর পূজা বিধিপূর্বক সম্পূর্ণ করায় দেবী অত্যন্ত প্রসন্ন হন, এরপর দেবী নিজেই সিংহের উপর চেপে দুই ভাইকে দর্শন দেন ও রামচন্দ্রকে কিছু উপদেশ দেন।
দেবী রামচন্দ্রকে গম্ভীরকন্ঠে বলেন, ‘রাম, আমি তোমার প্রতি অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়েছি তোমার মন যা চায় তাই তুমি প্রার্থনা কর। তুমি রাবণ বধের জন্য দেবগনের ইচ্ছায় মনুর পবিত্র বংশে জন্মগ্রহণ করেছ। তুমি স্বয়ং নারায়ণের অংশ, প্রাচীনকালে তুমি দেবতাদের মঙ্গলের জন্য মৎস্য অবতার ধারণ করে বেদকে রক্ষা করেছ। তুমি কূর্ম অবতার ধারণ করে মন্দার গিরিপর্বতকে ধারণ করেছ, রাম, তুমিই প্রাচীনকালে বরাহ অবতার ধারণ করেছ ও নিজের লীলা প্রকাশ করেছ, নৃসিংহ অবতারে তুমিই হিরণ্যকশিপুর দেহ বিদীর্ণ করে ভক্ত প্রহ্লাদকে রক্ষা করেছ! রঘুনন্দন! তুমিই পূর্বে বামন অবতার হয়ে বলির সঙ্গে ছলনা করেছিলে, তুমিই পরশুরাম হয়ে ক্ষত্রিয়কুলকে নির্মূলরূপে সংহার করেছ, সেই তুমিই এখন রাবণের দ্বারা পীড়িত হয়ে রাবণ বধের নিমিত্ত জন্মগ্রহণ করেছ। অতএব দেবতাগণ যে তোমার সহায় হবে এতে আর সন্দেহ কী? তুমি স্বয়ং নারায়ণের অবতার হয়ে রাবণ বধ করবে আর তোমার ভাই লক্ষ্ণণ শেষনাগের অবতার, সে অতুল ভুজবলশালী পুরুষ, রাবণের পুত্র ইন্দ্রজিৎকে সংহার করবে এ বিষয়ে নিশ্চিত। এই নিয়ে তুমি মনে কোন সন্দেহ রেখো না।”
অর্থাৎ যুদ্ধে কী হবে এবং কী হবে না তা দেবী আগাম রামচন্দ্র কে জানিয়ে দেন। এরপর দেবী রামচন্দ্রকে নির্দেশ দেন, “ তুমি রাবণকে সংহার করিয়া বসন্তকালে শ্রদ্ধার সহিত আমার পূজা করিয়া যথাসুখে রাজত্ব করিতে থাকিবে। রঘুবর! তুমি একাদশ সহস্র বৎসর এই পৃথিবীতলে রাজ্য করিয়া পুনর্ব্বার ত্রিদশ ভবনে গমন করিবে।”
এরপর দেবী অন্তর্হিত হলে রামচন্দ্র অত্যন্ত খুশি হলেন । রামচন্দ্র সেই কল্যাণকর ব্রত সম্পূর্ণ করলেন ও দশমী দিনে বিজয়ার পুজো করে মহর্ষি নারদকে বহুবিধ বস্তু দান করে সমুদ্রের উদ্দেশ্যে যুদ্ধের উদ্দেশ্য যাত্রা শুরু করলেন।