শ্রাবণী মেলা: দেবাদিদেব মহাদেব ও শ্রাবণ মিশে যায় বঙ্গদেশে

দেবাদিদেব মহাদেব হলেন ত্রিলোকের পরমেশ্বর, একমেবাদ্বিতীয়ম পরমব্রহ্ম। কালীপ্রসন্ন বিদ্যারত্ন লিখে গিয়েছেন-

‘‘শিব হতে শ্রেষ্ঠতর কিছুমাত্র নাই।

শ্রীশিব সবার শ্রেষ্ঠ জানিবে সবাই।।’’ 

শিবপুরাণ অনুযায়ী, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর মধ্যে প্রাচীনতম শিবই। তিনি নিজে স্বয়ম্ভূ। সৃষ্টি এবং লয় তাঁর দুই সত্ত্বা। এই শিবের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়েছে শ্রাবণ। শ্রাবণেই হয়েছিল সমুদ্রমন্থন। মন্থনে উঠে আসা গরল নিজ কণ্ঠে ধারণ করে মহাদেব হয়েছিলেন নীলকণ্ঠ, রক্ষা করেছিলেন সৃষ্টিকে। সে কারণেই শ্রাবণ মাস মহাদেবের উদ্দেশে উৎসর্গ করা হয়েছে। তাই শ্রাবণ মাস শিবের মাস হিসাবে পরিচিত। শ্রাবণ মাসে শিবের আরাধনা করলে মহাদেব প্রসন্ন হন। ভক্তের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করেন তিনি। 

 

সমুদ্র মন্থনের পর মহাদেব যখন বিষ পান করলেন, তখন হলাহলের তীব্র জ্বালা আর সইতে পারছিলেন না মহাদেব। দেবতারা তাঁর মাথায় জল ঢালেন। শিবলিঙ্গে জল অভিষেকের ধারা সেই থেকে চলে আসছে। আষাঢ় পূর্ণিমা অর্থাৎ গুরু পূর্ণিমা থেকে শ্রাবণ পূর্ণিমা অর্থাৎ রাখি পূর্ণিমা, অর্থাৎ এক মাস যাবৎ চলে শ্রাবণী মেলা। এই সময়কাল জুড়ে সমুদ্র মন্থনের কথা স্মরণ করে শিবের মাথায় জলাভিষেক, দুধাভিষেক করেন ভক্তরা। বাঁকে করে জল নিয়ে পায়ে হেঁটে চলেন সুদীর্ঘ পথ। কৃচ্ছসাধনই তো মুক্তির পথ, এই তো ভারতীয় দর্শন।

 

ভক্তের ঢল নামে তারকেশ্বরে। সেখানে শ্রাবণী মেলা পালিত হয় মহাসমারোহে। শ্যাওড়াফুলির গঙ্গা থেকে জল নিয়ে পায়ে হেঁটে ভক্তরা বাবা তারকনাথ শিবের মাথায় সেই জল অভিষেক করেন। বাংলার অন্যতম বৃহৎ শৈব তীর্থ হল তারকেশ্বর। প্রায় সাড়ে তিনশো বছর আগে তারকেশ্বর মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়। তারকেশ্বরের নাম ছিল তারপুর। পূর্ব রামনগরের রাজা ভারমল্ল সেখানে একটি শিবলিঙ্গ দেখতে পান। স্বপ্নাদেশে রাজা তারপুরেই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। সেই থেকে মন্দিরে পুজোর প্রচলন শুরু। আর একটি মতে, অষ্টদশ শতাব্দীতে জনৈক বিষ্ণুদাস সুদূর উত্তরপ্রদেশের অযোধ্যা থেকে তারকেশ্বর পৌঁছন। পার্শবর্তী রামনগর গ্রামে বসবাস করতেন তিনি। বিষ্ণুদাসের গোশালার গরুরা 

ভাটা মৌজার বেনা বনের জঙ্গলে চারণ করত। একটি গরুর বাট থেকে একটি প্রস্তর শীলার উপরে দুধ পড়তে হতে দেখা যায়। তিনি ও তাঁর ভাই ভাড়ামল্ল স্বপ্নাদেশ পেয়ে মহাদেবের মন্দির নির্মাণ করেন। 

 

উত্তর বাংলায় শ্রাবণী মেলা বসে জল্পেশে। প্রতি বছর শ্রাবণী মেলায় কয়েক লক্ষ ভক্তের সমাগম হয় জল্পেশ মন্দিরে। শিব এখানে অনাদি। কোচবিহারের রাজা বিশ্বসিংহ ১৫২৪ সালে জল্পেশ মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা করেন। ১৫৬৩ সালে মহারাজা নরনারায়ণ মন্দিরটির পুনর্নির্মাণ করান। প্রায় এক শতকেরও বেশি পরে রাজা প্রাণনারায়ণ ১৬৬৩ নাগাদ এই মন্দিরটি পুনর্নির্মাণ করেন। মন্দিরটি দীর্ঘকাল বৈকুণ্ঠপুরের রায়কতদের তত্ত্বাবধানে ছিল। ১৮৯৯ সালে রাজা জগেন্দ্রদেব রায়কতের স্ত্রী রানী জগদেশ্বরী দেবী এখানে শিবকে পুনপ্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

 

কেউ বলেন শ্রাবণে মর্ত্যে পা রেখেছিলেন শিব, আবার কেউ কেউ বলেন শ্রাবণ শিবের জন্মমাস। শ্রাবণ হল বর্ষার সময়। বারিধারায় শীতল হয় পৃথিবী। ক্ষেত শস্য শ্যামলা হয়ে ওঠে, নদী হয়ে ওঠে টইটুম্বুর। গ্রীষ্মের দাবদাহের পর প্রাণ পায় ধরণী। শিব শব্দের অর্থ মঙ্গলময়। পৃথিবী মঙ্গলময় হয়ে ওঠে শ্রাবণধারার আগমনে। শিব মানেই সৃষ্টি। জল ছাড়া প্রাণের সঞ্চার হয় না। গঙ্গা সেই জলকেই জটায় ধারণ করেন নটরাজ! এইভাবে মঙ্গলময় শিব আর সৃষ্টি মিলে মিশে এক হয়ে যায়।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...