কেন দেবী দুর্গা বারাণসীতে চিরকাল অধিষ্ঠান করেন? রাজা সুবাহুর কাহিনি

দেবী দুর্গা সবসময় বারাণসীতে থাকেন, যে কারণে বারাণসী অত্যন্ত পবিত্র তীর্থ বলে গণ্য করা হয়! কিন্তু অনেকেই জানেন না কেন এবং কোন সময় থেকে দেবী কাশীতে থাকেন? কার প্রার্থনায় সন্তুষ্ট হয়ে দেবী সবসময় কাশীতে বাস করা নিয়ে প্রতিশ্রুতি দান করেন। দেবী ভাগবত পুরাণে উল্লেখিত আছে দেবী দুর্গার কাশীতে বাস করার  ঘটনা ও রাজা সুবাহুর প্রার্থনার কথা। আজকে আপনাদের সেই ঘটনার কথাই বলব। 

 

baranasi durga

 

কাশীর অধিপতি ছিলেন রাজা সুবাহু। এক সময় তিনি বিপদে পড়ে দেবী দুর্গার শরণাপন্ন হন। দেবীর স্তোত্র পাঠ করেন, দেবী এই স্তোত্র পাঠে প্রসন্ন হন এবং রাজা সুবাহুকে দর্শন দান করেন। দেবী ভাগবতে ব্যাসদেব এই ঘটনার কথা বর্ণনা করেন।  সুবাহু দুর্গতিনাশিনী দেবীকে  দর্শন করে আহ্লাদিত হলেন এবং দেবী কৃপা পূর্বক তাকে দর্শন দিয়েছেন তা উপলব্ধি করে দেবীকে ভক্তি ভরে প্রণাম জানালেন।

 

দেবীর দর্শন যে এই পৃথিবীর সমস্ত ঐশ্বর্য দর্শনের কাছে তুচ্ছ সে কথা জানিয়ে সুবাহু বললেন, “সমগ্র পৃথিবীতে যত ঐশ্বর্য আছে , দেবলোককে যত ঐশ্বর্য আছে, ধরিত্রীতে যত সম্পদ আছে সেই সমস্ত সম্পদ একত্রিত করে যদি তার দর্শন করা যায় তবু দেবী রূপ দর্শনের কাছে তা তুচ্ছ!”-অর্থাৎ এই অংশে সুবাহু বুঝিয়েছেন দেবীর ঐশ্বর্য কতখানি! রত্ন ভান্ডারের আলোর ছটাকে হার মানায় দুর্গতিনাশিনীর তেজের ছটা! এরপর রাজা দেবীকে বললেন,‘দেবী আপনি আমার সহায় হোন, আমাকে বিপদ মুক্ত করুন, আপনি আমাকে এই বর দিন যে আপনার প্রতি আমার ভক্তি যেন চিরকাল অটল থাকে আর কৃপা পূর্বক চিরকাল এই বারাণসী নগরীতে আপনি অধিষ্ঠান করুন।”

 

কাশীপতি সুবাহু  দেবীর কাছে হাত জোড় করে প্রার্থনা করে বলেন, “আপনি যেমন ভাবে গোটা বিশ্বকে বিপদ থেকে রক্ষা করেন, তেমনভাবে এই বারানসীকে রক্ষা করুন। এই নগরী যতকাল পৃথিবীর বুকে টিকে থাকবে, ততকাল আপনি এই নগরীর প্রতি কৃপা বর্ষণ করবেন- আমার এই ইচ্ছা আপনি কৃপা পূর্বা পূরণ করুন। ‌ সমস্ত শত্রুর বিনাশ করে , পাপী মানুষদের বিনাশ করে- শুভ শক্তিকে জাগ্রত করে আপনি এখানে অবস্থান করুন। দেবী আপনি আমার প্রতি এই কৃপা করুন”-এইভাবে বারংবার প্রার্থনা করবার ফলে দেবী প্রসন্না হলেন এবং তিনি রাজা সুবাহুর প্রার্থনা মেনে নিলেন।

 

দেবী বললেন, “যতদিন পৃথিবী থাকবে ততদিন আমি বারানসীতে থাকবো।‌ সবসময় ভক্তগণ এখানে আমার দর্শন পাবে। এখানে আমি অচলা রূপে থেকেই দুষ্টের দমন করব আর শিষ্টের পালন করব আর ভক্তদের নিত্য দর্শন দেব”

 

অযোধ্যার রাজা সুদর্শন‌ এইবার সেই স্থানে এসে দেবীর প্রার্থনা ও স্তব করতে শুরু করলেন। তিনি ভক্তি ও শ্রদ্ধা সহকারে বললেন, “হে দেবী! হে দুর্গা! এই বিশ্বে সকলেই তার ভক্তদের প্রতি করুণাশীল হয়, কিন্তু মা! আমি দেখছি আপনি ভক্তিহীনকেও রক্ষা করেন, যেমন আমাকে রক্ষা করেছেন। আমি ভক্তহীন হ‌ওয়া সত্ত্বেও আপনার করুণা আমি পেয়েছি আর বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছি। আপনার অপরিসীম দয়া আমি অনুভব করেছি মা, কিন্তু এবার আপনিই বলুন আমার কর্তব্য কর্ম কী? আমি কী করব? কী আমার করা উচিত? কেমন উপায়ে আপনার ভক্তি করব? তাও তো আমার জানা নেই! আমাকে দর্শন দিয়ে আমার কর্তব্য কর্ম বলে দিন মা। আমাকে এই বিপদ সাগর থেকে উদ্ধার করুন।”


অযোধ্যা রাজ সুদর্শন এইভাবে বারংবার দেবীর স্তব স্তুতি করতে থাকলে দেবী তার প্রার্থনায় প্রসন্ন হয়ে তাকে দর্শন দিয়ে বললেন, “তুমি এইবার অযোধ্যায় ফিরে গিয়ে ক্ষত্রিয় ধর্ম অনুযায়ী রাজ্য শাসন করো, প্রজাদের কল্যান করো  আর নিয়মিত আমার পুজো করো। আমি অযোধ্যা নগরীর মঙ্গল করব। তবে তুমি শরৎ, মাঘ, চৈত্র ও আষাঢ় মাসের নবরাত্রি পুজো করবে। এই সময় নবরাত্রি পালন করা প্রত্যেক ভক্তদের উচিত। এছাড়া আমার পুজোর সময় অষ্টমী , নবমী ও চতুর্দশী তিথিতেও ভক্তি ভরে আমার পুজো করবে এবং বলি দেবে।”- এই সমস্ত উপদেশ দান করবার পর দেবী অন্তর্হিত হলে সুবাহু সহ অন্যান্য রাজাগন সুদর্শনের কাছে এসে করজোড়ে প্রণাম করে জিজ্ঞেস করলেন,‘আপনার কৃপাতেই আমরা দেবী দুর্গার দর্শন পেয়েছি, এবার আপনি আমাদের পথ দেখান, আপনি ধর্মত আমাদের গুরু।  দয়া করে আপনি আমাদের বলুন যে এই দেবী শক্তি আসলে কে? কে দেবী দুর্গা এবং তার উদ্ভব কোথায়?’



সুদর্শন তখন বিনয়ের সঙ্গে বললেন,‘ দেবীর মাহাত্ম্য বর্ণনা করা মোটেই সহজ নয়। ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর‌ও দেবীর তত্ত্ব প্রকৃত পক্ষে বলতে পারেন না। আমি তো সেখানে নিমিত্ত মাত্র। তবুও তোমরা যখন শুনতে চাইছো তখন শোনো দেবীর কৃপায় আমি দেবীর মাহাত্ম্য কথা বলার চেষ্টা করছি, এই জগতে সৃষ্টি,স্থিতি, পালন , সংহার সব দেবীর দ্বারাই হয়। আমরা যে মায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকি তাও দেবীর রূপ, তার ইচ্ছাতেই সৃষ্টি হয় আর তার ইচ্ছাতেই ধ্বংস হয়। তিনিই আবার পালন করেন। দেবী দুর্গার চার রূপ আছে, সত্ত্ব, রজ, তম, নির্গুণ। সত্ত্ব‌ গুণের আধার রূপে তিনি মহালক্ষ্মী অর্থাৎ পালণকারিণী। রজোগুণাময়ী হিসেবে তিনি সৃষ্টি করেন অর্থাৎ ব্রহ্মাণী, তমগুণের আশ্রয় স্বরূপ তিনি কালী হয়ে সংহার করেন আর নির্গুণ পরাশক্তি রূপে তিনি সর্ব কাম প্রদায়িনী হয়ে বিরাজমান। শৈশবে ঋষিদের কাছ থেকে আমি এক মহা শক্তিশালী মন্ত্র লাভ করেছিলাম, সেই মন্ত্র নিত্যদিন ভক্তি সহকারে আমি জপ করতাম, সেই মন্ত্র জপের ফলে দেবী আমাকে রক্ষা করেছেন ও দর্শন দান করেছেন।”

 

ব্যাসদেব সবশেষে বলেন, রাজাগন অযোধ্যা রাজ সুদর্শনের মুখ থেকে দেবীর এই মাহাত্ম্য ও চার গুণের তত্ত্ব কথা শুনে ভক্তি ভরে দেবীর উদ্দেশ্যে প্রণাম জানান ও নিজের গৃহে ফিরে যান। অন্যদিকে রাজা সুদর্শন বিজয় লাভ করে নববধূকে নিয়ে অযোধ্যায় ফিরে গেলে প্রজারা তাকে অভ্যর্থনা জানান এবং রাজা আনন্দের সঙ্গে রাজ্য শাসন করতে থাকেন অন্যদিকে সুবাহুর নগরী বারাণসী পরম পবিত্র ধামে পরিণত হয় , দেবী এখানে অচলা রূপে অবস্থান করেন আর বারাণসী মাহাত্ম্যের সঙ্গে জড়িয়ে যায় বারাণসী রাজ সুবাহুর নাম।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...