কূর্ম পুরাণের শুরুতেই দেখা যায় বিশালাক্ষী দেবীর বর্ণনা রয়েছে। কিন্তু এই দেবী আসলে কে? কীভাবেই বা তার উত্থান হলো? ইনি পুরাণের ঠিক কোন দেবী? কোন ঋষিই বা এই দেবীর কথা বলতে শুরু করলেন?-আজকের প্রতিবেদনে এগুলিই সবিস্তারে বলব। কূর্ম পুরাণ অনুযায়ী, নৈমিষারণ্যবাসী মহর্ষিরা রোমহর্ষণ নামের একজন ঋষিকে পুরাণ সংহিতা নিয়ে একাধিক প্রশ্ন করতে থাকেন ও তার উত্তরেই রোমহর্ষণ ঋষি সমুদ্র মন্থনের প্রসঙ্গ তোলেন।
মহর্ষিরা রোমহর্ষণ নামের ঋষির স্তুতি করে বললেন, হে মহাবুদ্ধি সূত, তুমি ইতিহাস ও পুরাণ বিষয়ে জ্ঞান লাভের জন্য ব্রহ্মর্ষিদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ভগবান ব্যাসকে সেবা করেছো বলেই লোকে তোমাকে রোমহর্ষণ বলে, কারণ দ্বৈপায়ন ঋষির বাক্য শুনে তোমার শরীর রোমাঞ্চিত হয়েছিল, পুরাণ সংহিতা বলবার জন্য ব্রহ্মার যজ্ঞ শেষে পুরুষোত্তমের অংশ থেকে তোমার উৎপন্ন হয়েছিল, তুমি পুরাণ বিশেষজ্ঞ। তুমি পুরাণ কথা বলো। তখন মহর্ষিদের কথা শুনে সূত অর্থাৎ রোমহর্ষণ ঋষি ব্যাসদেবকে প্রণাম করে পুরাণ কথা বলা শুরু করলেন।
রোমহর্ষণ ঋষি বললেন, এই পুরাণ কথা শুনলে সকল পাপ নষ্ট হয়ে যায়। পাপিষ্ট পরম গতি লাভ করে। তবে এই পবিত্র কথা নাস্তিকের কাছে বলতে নেই। সকল ব্যক্তির মধ্যে যাদের শ্রদ্ধা আছে, যারা শান্ত ও ধার্মিক, তাদের কাছে নারায়ন মুখ নিঃসৃত এই পুরাণ কথা বলতে হয়। এরপর পুরাণের ভাগের কথা বলতে শুরু করলেন। সূত বললেন, পুরাণ ১৮ টি। ব্রহ্ম পুরাণ , পদ্ম পুরাণ, বিষ্ণু পুরাণ, শিব ভাগবত , ভবিষ্য পুরাণ, নারদীয় পুরাণ, মার্কন্ডেয় পুরাণ, অগ্নি পুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, লিঙ্গ পুরাণ, বরাহ পুরাণ, স্কন্দ পুরাণ, বামন পুরাণ, কূর্ম পুরাণ, মৎস্য পুরাণ, গরুড় পুরাণ,বায়ু পুরাণ, ব্রহ্মান্ড পুরাণ। এছাড়াও কিছু উপপুরাণ আছে। এই উপ পুরাণের মধ্যে আছে সনৎ কুমারের বলা আদি পুরাণ, নরসিংহ পুরাণ, কুমার কথিত স্কন্দ পুরাণ, শিব কথিত শিব পুরাণ, দুর্বাসা কথিত আশ্চর্য পুরাণ, নারদীয় পুরাণ ইত্যাদি। তার মধ্যে পবিত্র কূর্মকরণ হল পঞ্চদশ পুরাণ।
এরপর সূত সংহিতার একাধিক প্রভেদের কথা বললেন। সূত এই প্রসঙ্গে আরও বললেন, এই সংহিতার মধ্যে সৃষ্টি ও প্রলয়ের কথা আছে, রাজা ও ঋষির বংশাবলি, বিভিন্ন ঋষিদের চরিত্র গাঁথা ও তীব্র পূণ্য প্রসঙ্গের কথা ইত্যাদি আছে। সমুদ্র মন্থনের কথা আছে ও বিশালাক্ষী দেবীর কথা আছে। সমুদ্র মন্থনের সময় মন্দার পর্বতকে মন্থন দন্ড রূপে গ্রহণ করে ক্ষীর সাগর মন্থন করা হয়। সেই সময় অমৃত পাবার জন্য দেবতা ও দানবেরা মিলিত হয়েছিলেন আর ভগবান নারায়ণ এই কাজে সাহায্য করবার জন্য মন্দার পর্বতকে ধারণ করেছিলেন। এতে দেবতা এবং ঋষি প্রত্যেকই তুষ্ট হন।
এরপর সেই মন্থনের সময় নারায়ন বল্লভা দেবী বিশালাক্ষীর উত্থান হয়। দেবীর উত্থানের পর বিষ্ণু তাকে গ্রহণ করেন আর তার রূপের ছটায় উপস্থিত সকলেই মুগ্ধ হন। মন্থনের পর দেবতারা সকলেই বিশালাক্ষী দেবীর পরিচয় জানতে চান। তখন ভগবান নারায়ণ দেবতাদের বললেন, এই দেবী তারই এক নিজ রূপ। ইনি ব্রহ্মরূপিনী, পরমাশক্তি। এই দেবী হলেন তারই মায়া, প্রিয়া ও অন্তহীনা। তিনিই আবার জগদ্ধাত্রী। এই দেবীর মায়ার সাহায্যেই আবার ভগবান বিষ্ণু জগতকে পালন করে থাকেন। ভগবান নারায়ণ আরও বললেন, দেবী স্বয়ং মায়া, এই বিপুল মায়াকে অতিক্রম করা যায় না। ব্রহ্মা আদি দেব সহ সকল দেবতারা শক্তিমান হয়েছেন এই মায়ারই অংশে। ইনি সর্বশক্তি ও সর্বজগত প্রসূতি। ইনি পদ্মালয়া ও শঙ্খ চক্রপদ্ম হস্তা।
অর্থাৎ কূর্ম পুরাণ অনুযায়ী বিশালাক্ষী দেবী হলেন বিষ্ণু প্রিয়া লক্ষ্মী দেবী , তিনি পরমা প্রকৃতি, তিনি মায়া। এই কূর্ম পুরাণে বিশালাক্ষী দেবী ও নিজেকে ভগবান নারায়ণের অভিন্না হিসেবেই উল্লেখ করেছেন। আবার নারায়ণ স্বয়ং বলছেন দেবী বিশালাক্ষী হলেন জগদ্ধাত্রী, সর্ব জগত প্রসূতি। বিশালাক্ষী শব্দের অর্থ হলো, যে দেবীর বিশাল অক্ষী রয়েছে, আবার, শিব পুরাণে বলা হয় দেবী বিশালাক্ষী হলেন পার্বতীর অংশ। কাশীর বারাণসীতে ৫১ সতীপীঠের মধ্যে অন্যতম একটি সতীপীঠ আছে দেবী বিশালাক্ষীর মন্দির, যেখানে দেবীকে সতী বা পার্বতীর রূপ হিসেবে ধরা হয়।
প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী বিশালাক্ষী দেবীর মন্দিরে মা সতীর কানের দুল পতিত হয়েছিল। অর্থাৎ বিভিন্ন পুরাণে বিশালাক্ষী দেবীকে বিভিন্ন ভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
কূর্ম পুরাণ অনুযায়ী দেবী বিশালাক্ষী হলেন লক্ষীর রূপ, স্কন্দ পুরাণে তাকে বলা হয় পার্বতীর রূপ, আবার কিছু লোকবিশ্বাস অনুযায়ী দেবী বিশালাক্ষী হলেন অন্নপূর্ণার রূপ। অর্থাৎ এই সকল বিষয় পড়লে মনে হয় যে, দেবী বিশালাক্ষী হলেন পরমাপ্রকৃতি আদি শক্তি। কখনও তিনি শিব প্রিয়া কখনও তিনি বিষ্ণু প্রিয়া, তিনি অনন্ত জ্ঞান ও শক্তির আধার, তার থেকেই সকল দেব দেবীর সৃষ্টি এবং তার শক্তিতেই সকলে বলীয়ান। তিনি জগন্মাতা।
তথ্য সংগ্রহঃ কূর্ম পুরাণ, ইন্টারনেট