নিম করোলি বাবার বাঙালি শিষ্য কে ছিলেন জানেন?

জটা নেই। গায়ে ধূলো নেই। নেই কোন নির্দিষ্ট আসন বা যাগযজ্ঞ স্থল। তবু তাঁকে ঘিরেই ভিড়। দূর দেশ থেকে উড়ে আসে ভক্তরা। কিন্তু তিনি বলেন, ‘ম্যায় কোই বাবা কো নেহি জানতা’, হনুমাজীকে মন্দির মেঁ উন্সে প্রার্থণা করো’।

সাদা ধুতি আর কম্বল সম্বল। নিজেকে বলতেন ‘প্রসাদওয়ালা বাবা’। ভক্তরা তাঁকে ডাকত ‘মহারাজজী’। নিম করোলি বাবা। অন্য নামে নিম করারি বাবা।

তাঁর দুই সত্ত্বা। একটি ভক্তদের ‘মহারাজজী’, অন্যটি ‘লক্ষ্মী নারায়াণ শর্মা’। উত্তরপ্রদেশের ফিরোজাবাদ জেলার আকবরপুরে ১৯০০ সালের গোড়ার দিকে এক মাঘের শুক্ল পক্ষ অষ্টমীতে তাঁর জন্ম হয়। পিতা দুর্গাপ্রসাদ শর্মা ছেলের নাম রাখেন লক্ষ্মী নারায়ণ। ছোটবেলা থেকে ভিড় থেকে দূরে একা থাকতে পছন্দ করতেন। বৈরাগী স্বভাব দেখে মাত্র এগারো বছর বয়সে ব্রাহ্মণ কন্যা খুঁজে বিয়ে দিয়ে দিলেন বাবা। কিন্তু ধরে রাখতে পারলেন না ছেলেকে। বিয়ের ঠিক পরেই ঘরছাড়া হল সে।

প্রথম গুজরাট, তারপর দেশের নানা প্রান্তে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। এভাবেই কেটে গেল ১০-১৫ বছর। বাড়ির সঙ্গে একেবারে কোনও যোগাযোগ নেই। নিম করোলি বাবা গুজরাটে পরিচিত ছিলেন ‘তালাইয়াওয়ালা বাবা’ নামে। গুজরাটের ভাবানিয়া গ্রামে ছোট্ট দীঘির পাশে তিনি থাকতেন। গ্রামের মহিলারা জল আনতে আসত সেখানে। তারাই একদিন আবিষ্কার করেন নবীন সাধুকে।

এছাড়াও ‘তিকোনিয়াওয়ালে বাবা’, ‘হান্ডিওয়ালে বাবা’ এমন অনেক নাম তাঁর। বাবার ডাকে ঘরে ফিরে নিয়েছিলেন। কয়েক বছর গৃহীর জীবনযাপন করেন, দুই পুত্র এক কন্যার জনক হন। গৃহীর জীবনেও তিনি ব্যস্ত থাকতেন সেবার কাজে।  কিন্তু ঘর তাঁকে কোনওভাবেই বেঁধে রাখতে পারেনি। উত্তর প্রদেশের একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চলে চলে যান। সেখানে তাঁর নতুন নাম হয় ‘বাবা লছমন দাস’। অনেক পরে তিনি ‘নিম করোরি’ গ্রামে থাকতে শুরু করেন, সেখানে থেকেই তাঁর পরিচিতি শুরু হয় ‘নিম করোলিবাবা’ নামে। ১০৪০-এ তিনি কুমায়ন যাত্রা করেন। তিনি যাওয়ার পর কুমায়নে হনুমান মন্দির গড়ে ওঠে।

‘নীব করোরি’ স্টেশন নিয়ে একটি কাহিনি প্রচলিত আছে। সেই কাহিনি অনুযায়ী, একবার বেশ কয়েকদিন অভুক্ত ছিলেন নিম করোলি বাবা। তখন তিনি ‘বাবা লছমন দাস’। ক্লান্ত দেহে উঠে পড়েন টড়েনের ফার্স্টক্লাস কামরায়। যথা সময়ে টিকিট পরীক্ষক আসেন। টিকিট না থাকার কারণে বাদানুবাদ হয়। টিকিট পরীক্ষক তাঁকে ফধাক্কা দিয়ে নামিয়ে দেন টড়েন থেকে। ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয় তাঁর ঝোলা আনুসাঙ্গিক। কিচ্ছু না বলে একটা গাছের তলায় বসেন তিনি। খানিক পর দেখা যায় কিছুতেই ট্রেন চালু করতে পারেন না চালক। ছুটে আসে ইঞ্জিনিয়াররা। তাতে কোনও সমাধান নেই। অবস্থা এমন হয় যে ম্যাজিস্ট্রেটকেও ছুটে আসতে হয়। তিনি চিনতেন লছমন দাস সাধুকে। টিকিট পরীক্ষককে বলেন ক্ষমা চেয়ে নিতে সাধুজীর থেকে। এবং ট্রেনের সেই আসনে তাঁকে ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু লছমন দাস বাবা নারাজ। অনেক অনুরোধে শেষ পর্যন্ত রাজী হন তিনি, কিন্তু দুটি শর্ত দেন। এক, ট্রেনে সহায় সম্বলহীন সাধুদের সঙ্গে কখনও খারাপ ব্যবহার যেন না করা হয় আর দুই, এই ‘নীব করোরি’তে যেন মানুষের সুবিধায় একটি স্টেশন গড়ে তোলা হয়। তাঁর প্রস্তাব মেনে নেওয়া হয়।     

আশ্রমতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন না, কিন্তু সাধনায় ডুবে থাকার জন্য তপোস্থল গড়ে তোলেন উত্তরাখন্ডের আলমোড়া নৈনিতাল থেকে ৩১ কিলোমিটার দূরে কোশি নদীর তীরে কাইঞ্চি ধামে। প্রতিবছর ১৫ জুন কাইঞ্চি ধামে বিশেষ মেলাও অনুষ্ঠিত হয়।    

নিম করোলি বাবার শেষ জীবন কাটে বৃন্দাবনে। ১৯৭৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তিনি দেহত্যাগ করেন। বৃন্দাবনের পরিক্রমা রোডে অটলা চুঙ্গিতে তাঁর আশ্রম।

নিম করোলি বাবার সঙ্গে যোগ ছিল বাংলার। শোনা যায় তিনি দক্ষিণেশ্বরেও এসেছিলেন। তাঁর বিশেষ প্রিয় এক ভক্ত ছিলেন বাঙালি। নাম সুধীর মুখোপাধ্যায়। পরিচিত ছিলেন ‘দাদা মুখোপাধ্যায়’ নামে। এলাহা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ছিলেন তিনি। তাঁর সঙ্গে নিম করোলি বাবার প্রথম সাক্ষাৎ এবং পরবর্তী পর্বে যুক্ত হয়ে পড়া নিয়ে প্রচলিত আছে একাধিক কাহিনি।
নিম করোলি বাবা বিভিন্ন জায়গায় হনুমান মন্দির থাপন করেন। ভক্তরা তাঁকে হনুমানজীর অবতার মানতেন। উত্তরপ্রদেশ, লখনউ, বৃন্দাবন এভাবে প্রায় ১০৮ টি। টেক্সাস, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রম আছে।

এক ভক্ত বাবা রামদাসের লেখা বইয়ের সূত্রে ইউরোপ জানতে পারে তাঁর কথা। তারপর থেকেই বিদেশের মানুষ তাঁর খোঁজে াসতে শুরু করে কোশির তীরে।

যে কোনও দেশের যে কোনও ভক্তই দর্শন করতে পারে তাঁর আশ্রম। অনুমতি সাপেক্ষে তিন দিন থাকাও যায়।

নিম করোলি বাবা বহু মানুষের জীবন বদলে দিয়েছিলেন। তাঁর ভক্ত তালিকায় যেমন নামী মানুষরা আছেন, তেমনই আছেন অজস্র সাধারণ মানুষ। কিন্তু কীসের টানে তাঁর কাছে ছুটে আসত মানুষ। এই ধারায় আজও কোনও পরিবর্তন নেই।

ভক্তিমার্গের পথিক এই সাধক বলতেন সহজের মাধ্যমেই বিশ্বদর্শন সম্ভব। হৃদয়ে অর্থ নয়, ঈশ্বর থাকুক, অর্থের জায়গা তো ব্যাঙ্কে। তাঁর দর্শনে ঈশ্বর একজনই। সকলকে ভালোবাসা, সকলকে সেবা আর ঈশ্বরকে স্মরণ।

মার্ক জুকেরবার্গ থেকে স্টিভ জোবস, জুলিয়া রবার্টস থেকে বিরাট কোহলি দর্শন করেছেন নিম করোলি বাবার আশ্রম। ২০১৫ সালে জুকেরবার্গ আসেন তাঁর নৈনিতালের আশ্রমে। তারও আগে ১৯৭৪-এ স্টিভ জোবস তাঁর বন্ধু ডনকে নিয়ে যান সেই আশ্রমে। আর জানুয়ারীর শুরুতে বিরাট-অনুষ্কা। আশ্রম থেকে ঘুরে আসার পরই ক্রিকেট মাঠে বিরাটের চমকে দেওয়া সাফল্যে নতুন করে খোঁজ শুরু হয়েছে তাঁর। অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগছে নিম করোলি বাবার আশ্রম  দর্শনই কি বিরাটের সাম্প্রতিক সাফল্যের  কারণ?

সেই রসায়ন জানতে হলে নতুন করে সন্ধান করতে হবে এই আধ্যাত্মিক পুরুষের সাধন-দর্শন।    

 

তথ্য সূত্রঃ nkbashram.org

Neebkaroribaba.com

Ramdas.org

Financial Express

Sri Siddhi maa- Penguin Books

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...