দশমহাবিদ্যার দশ রূপ কী কী?

হিমালয়রাজ দক্ষ বৃহস্পতি নামে এক মহাযজ্ঞের আয়োজন করেন। সেই যজ্ঞে তিনি ত্রিলোক ও সমস্ত দেবতাকে নিমন্ত্রণ জানান, কিন্তু কন্যা সতী ও জামাতা মহেশ্বরকে ছাড়া। পিতার আয়োজনের খবর পেয়ে সতী বিনা আমন্ত্রণেই পিতৃগৃহে যেতে চান। নারাজ থাকেন মহেশ্বর। তাঁর অনুমতি না পেয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন দেবী। তখন শিবকে ভয় দেখানোর জন্য দেবী দশ রূপ ধারণ করেন। দশ দিশায় তিনি আবির্ভূত হন। তাঁর এই রূপ দশমহাবিদ্যা নামে খ্যাত। 

কালী: দশমহাবিদ্যার প্রথম রূপ কালী। সর্বসংহারকারিণী, জন্ম ও শক্তির দেবী। কালীকুলের ও সম্প্রদায়ের সর্বোচ্চ দেবী হলেন এই কালী। শুম্ভ ও নিশুম্ভের অত্যাচার থেকে রক্ষা পেতে দেবগণের প্রার্থনায় দেবী দুর্গার ভ্রকুটি থেকে জন্ম হয় দেবী কালীর। চতুর্ভূজা দেবীর ডান দিকে হাতে খড়্গ ও চন্দ্রহাস। বাম হাতে চর্ম ও পাশ। গলায় নরমুণ্ড, দেহ পশু চর্ম আবৃত। বড় বড় দাঁত,রক্ত চক্ষু ও বিস্তৃত মুখ, স্থুল কর্ণ। দেবীর বাহন কবন্ধ। তন্ত্রে বাহন মহাকাল এবং দেবীকে শান্ত ও উগ্র দুই রূপেই বর্ণনা করা আছে।

 

DasaMahaVidya

 

তারা: দশমহাবিদ্যার দ্বিতীয় রূপ তারা। তারা পথপ্রদর্শক ও রক্ষাকারিণী দেবী। তাঁকে তারিণী দেবীও বলা হয়। তিনি বিশ্বের উৎস হিরণ্যগর্ভের শক্তি এবং মহাশূন্যের প্রতীক। ভীষণ দর্শনা কালীর ভয়ে মহাদেব ভীত হলে সতী দ্বিতীয় বার আবির্ভূত হন তারা রূপে। নব যৌবনা দেবীর গায়ের রঙ নীল। পরিধানে ব্যাঘ্র চর্ম। দেবী চতুর্ভূজা। দেবীর অবস্থান প্রজ্জলিত চিতার মধ্যে। তাঁর বাম পা শিবের বুকে অবস্থিত। তন্ত্রশাস্ত্র অনুসারী দেবী তারা মহানীল সরস্বতী।

 

DasaMahaVidya1

 

ষোড়শী: দশমহাবিদ্যার তৃতীয় রূপ ষোড়শী। এই দেবী পূর্ণতা ও পূর্ণাঙ্গতার স্বরূপ। স্রীকুল সম্প্রদায়ের সর্বোচ্চ দেবী তিনি। তান্ত্রিক পার্বতী নামে পরিচিতা। তিনি আবার ললিত ত্রিপুরাসুন্দরী বা ষোড়শী নামেও পরিচিত।

 

DasaMahaVidya2

 

তারা রূপ ত্যাগ করে মহাদেবের সামনে আবির্ভূত হলেন ষোড়শী রূপে। দুর্গার অন্য রূপ শতাক্ষীর দেহ হতে আবির্ভূত হন ষোড়শী রূপে। ষোড়শীর অপর নাম স্ত্রী বিদ্যা। ত্রিপুরা সুন্দরী, রাজ রাজেশ্বরী। ত্রিপুর শব্দের অর্থ বলা হয়েছে যিনি ইড়া, পিঙ্গলা ও সুষম্নাতে অথবা মন, চিত্ত ও বুদ্ধিতে অবস্থিত। দেবীর চার হাত, গায়ের রং ভোরের প্রথম সূর্যের মতো। মহাদেবের নাভি পদ্মের উপর দেবী আসীন। নীচে দেবগণ স্তব করছেন। শঙ্করাচার্য ও অভিনব গুপ্ত কর্তৃক এই দেবী পূজিতা হয়েছিলেন।

ভুবনেশ্বরী : দশমহাবিদ্যার চতুর্থ রূপ ভুবনেশ্বরী। পার্থিব জগতের শক্তিসমূহের প্রতীক তিনি। তন্ত্র শাস্ত্রে জানা যায়, মহাদেবের উপর রাগে দেবী ষোড়শী রূপ ধারণ করেন। শিবের বক্ষে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে নিজেই ভীত হন। পরে সেই ছায়া নিজের জেনে সুস্থির হন। তাঁর সেই রূপ ভুবনেশ্বরী। এই দেবী রক্তবর্ণা। চার হাতে অস্ত্র ও বরাভয় মুদ্রা। চার দিকে চার জন দেবী এই দেবীকে ঘিরে আছেন। দেবীর আরও সহচরী আছে।তিনি শাকম্ভরী নামেও পরিচিত।

 

DasaMahaVidya3

 

ভৈরবী : মহাবিদ্যার পঞ্চম রূপ ভৈরবী। দেবী চতুর্ভুজা, হাতে অক্ষমালা। দেবী অস্ত্রহীন। এই দেবী বিদ্যা ও ধনদাত্রী। তাঁর বাম হাতে পুস্তক ও অভয় মুদ্রা। ডান হাতে বর মুদ্রা ও জপমালা। নৃসিংহের অভিন্ন শক্তি ত্রিপুরা ভৈরবী। চৌষট্টি যোগিনীদের মধ্যে প্রধানতমা ভৈরবী।

 

DasaMahaVidya4

 

ছিন্নমস্তা: দশমহাবিদ্যার ষষ্ঠ রূপ হল ছিন্নমস্তা। এই রূপে দেবীর উলঙ্গিনী মূর্তি। তিনি স্বহস্তে নিজ মস্তক ছিন্ন করে নিজ রক্ত পান করেন। বাম হস্তে নিজের ছিন্ন মস্তক এবং গলা থেকে নির্গত রক্তের স্রোত তিন ধারার মধ্য মাঝের ধারা সেই মস্তক পান করছেন। গলায় মুণ্ডমালা এবং নাগ উপবীত। তাঁর বামে ডাকিনী ও ডানে বর্ণিনী বাকি দুই রক্তধারা পান করছেন। সবাই দিগম্বরী, মুণ্ডমালিনী ও মুক্তকেশী। তিনি এই রূপে চক্রপথে আত্মধ্বংস ও আত্মপুনরুজ্জীবনের মাধ্যমে সৃষ্ট জগতের অবিরাম বিদ্যমানতা শক্তির প্রতীক।

 

DasaMahaVidya5

 

দেবী ছিন্নমস্তার সৃষ্টি নিয়ে আরও একটি কাহিনির উল্লেখ পাওয়া যায়।

সেই কাহিনি অনুযায়ী, একদিন দেবী পার্বতী তাঁর দুই সহচরী ডাকিনী ও বর্ণিনীকে নিয়ে মন্দাকিনী নদীতে স্নান করতে গিয়েছিলেন। স্নানরতা অবস্থাতেই সঙ্গিনীরা বলে, ‘আমরা ক্ষুধার্ত’। ডাকিনী বর্ণিনী মাংসভুক। তখন দেবী নিজের নখরে নিজের কণ্ঠচ্ছেদ করেন। মস্তকটি এসে পড়ে তাঁর বাম হস্তে। ছিন্ন কণ্ঠ থেকে তিন ধারায় বইতে লাগল রক্ত। সেই রক্ত পান করতে লাগল ডাকিনী আর বর্ণিনী। মধ্য ধারাটি দেবী নিজেই। শিবকে ভয় দেখাতে এই রূপ ধারণ করেছিলেন তিনি।

ধূমাবতী: দশমহাবিদ্যার সপ্তম রূপ দেবী ধূমাবতী।  বিধবা দেবীমূর্তি। অগ্নির দ্বারা জগৎ ধ্বংসের পর ভস্মরাশির মধ্য থেকে যে ধূম নির্গত হয়, তার স্বরূপ হলেন এই ধূমাবতী। তিনি কখনও কখনও আবার অলক্ষ্মী বা জ্যেষ্ঠাদেবী নামেও অভিহিতা হন।

দেবীর ধূমাবতী রূপেরও একটি গল্প আছে।  একদিন কৈলাসে পার্বতী প্রচণ্ড ক্ষুধায় কাতর হয়ে বারবার শিবের কাছে অন্ন চান। এদিকে ঘরে কণামাত্র চাল নেই। ক্ষিপ্ত হয়ে শিবকে গ্রাস করেন দেবী।

 

DasaMahaVidya6

 

সঙ্গে সঙ্গে দেবীর দেহ হতে ধোঁয়া নির্গত হতে থাকে। সেই ধোঁয়া পার্বতীকে বিবর্ণ করে দেয়। ধোঁয়ার আবৃত দেহ থেকে শিব বের হয়ে বলেন, ‘তুমি যখন ক্ষুধায় আমাকে গ্রাস করেছ তখন তুমি বিধবা হয়েছ। এই বেশে ধূমাবতীরূপে পূজিতা হবে। তাই ধূমাবতী বিধবা,শিবহীন, ভয়ঙ্করী, রুক্ষ মলিন বসনা, বিবর্ণ কুণ্ডলা, বিরল দন্তা, নিত্য বুবুক্ষিতা, অতিকৃশা, বৃদ্ধা। ধূমাবতীর দুই হাত, একহাতে কুলা ও অন্য হাতে ধর। ইনি রথরূঢ়া। রথের ধ্বজ চারটিতে চারটি কাক।

বগলামুখী: দশমহাবিদ্যার অষ্টম রূপ বগলা। রুরু নামক দৈত্যের পুত্র দুর্গম দেবতাদের চেয়ে বলশালী হওয়ার জন্য ব্রহ্মার তপস্যা করে বরপ্রাপ্ত হন। তাকে প্রতিহত করতে দেবতারা তখন দেবী ভগবতীর আরধনা করেন। দেবী আর্বির্ভূত হয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। দেবীর গায়ের বর্ণ পীত। বসন পীত বর্ণ। সুধা সমুদ্রের মাঝে সিংহাসনে উপবিষ্টা। শববাহনা। দ্বিভূজ দেবী বাম হাতে দুর্গম অসুরের জিহ্বা ধরে ডান হাতে গদা দিয়ে শত্রু নাশ করেনএই যুদ্ধে দেবীর দেহ হাতে কালী, তারা, ভৈরবী, রমা, মাতঙ্গী, বগলা,কামাক্ষী, জম্ভিনী, মোহিনী, ছিন্নমুণ্ডা, গুহ্যকালী প্রভৃতি মহাশক্তি বের হয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন।

 

DasaMahaVidya7

 

মাতঙ্গী : কর্তৃত্ব শক্তির দেবী মাতঙ্গী। ইনি তান্ত্রিক সরস্বতী। দেবী শ্যামবর্ণা, ত্রিনয়না, চতর্ভূজা ও সিংহাসনে উপবিষ্টা। মাতঙ্গ মুনির আশ্রমে দেবতারা আরাধনায় ইনি মাতঙ্গ মুনির স্ত্রীর শরীর থেকে বের হয়ে শুম্ভ ও নিশুম্ভ দৈত্যদের বধ করেন।

 

DasaMahaVidya8

 

কমলাকামিনী : দশমহাবিদ্যার শেষ বা দশম রূপ ঐশ্বর্য লক্ষ্মী কমলা। বরাভয় প্রদায়িনী শুদ্ধ চৈতন্যের দেবী কমলাকামিনী। ভাগ্যদেবী লক্ষ্মীর অন্যরূপ কমলাকামিনী। ইনি তান্ত্রিক লক্ষ্মী নামেও অভিহিতা। কমলার উৎপত্তি সমুদ্র মন্থনের সময়। দেবী চতুর্ভূজা। দেবীর দুই ডান হাতে পারিজাত পুষ্প, বাম দিকে উপর হাতে বরমুদ্রা, সমুদ্রের মধ্যে দেবী প্রস্ফুটিত পদ্মে আসীন। দুই পাশে দুইটি হাতি শুড় দিয়ে কলসে করে জল নিয়ে দেবীকে স্নান করাচ্ছে।

 

DasaMahaVidya9

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...