নীল-নুনের কালো ইতিহাস শোনায় গোকুলচন্দ্র মিত্রের বাগবাজার বাড়ি

আঠারো শতকের কলকাতা অনেক কিছুর সাক্ষী। এই কলকাতার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে অনেক বনেদী পরিবারের ইতিহাস। বহু প্রাচীন স্থাপত্যের ইতিহাস। তার সঙ্গে জুড়ে রয়েছে মানুষের কথা। মানুষের দুঃখের কথা, অত্যাচারের কথা। নীল ব্যবসায়ীদের কথা দীনবন্ধু মিত্রের কল্যাণে অজানা নেই। কিন্তু আঠারো শতকের সময়কালে ভারতবর্ষের নুন ব্যবসায়ীদের ওপরেও চলেছিল চরম অত্যাচার। সেই ইতিহাস কোথাও রচিত নেই। কলকাতার অন্যতম উচ্চবিত্ত পরিবার মিত্র পরিবারের গোকুল মিত্রের বাড়ির সঙ্গে যুক্ত রয়েছে সেই ইতিহাস।

 

কলকাতায় নুনের ব্যবসা যে কী ভীষণ লাভজনক ছিল তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ চিৎপুরের গোকুল চন্দ্র মিত্র। বিষ্ণুপুরের রাজা চৈতন্য সিংহ তাঁর কাছে টাকা ধার নিয়েছিলেন, পরিবর্তে বাঁধা রাখতে হয়েছিল রাজবাড়ীর বিখ্যাত ও বহু কথিত মদনমোহনের বিগ্রহ। বাগবাজারে এই মদনমোহনের নামেই একটি অঞ্চল অর্থাৎ পাড়ার নাম রয়েছে মদনমোহন তলা। এখানেই বাড়ি রয়েছে গোকুল চন্দ্র মিত্রের। কলকাতার অন্যতম বনেদী বাড়ি। আড়াইশো বছর আগে এই বাগবাজারকে বলা হতো বারুদখানা, স্কট নামের এক সাহেব এখানে কেল্লা ও বারুদখানা তৈরি করেছিলেন। নবাব সিরাজদৌলার কাছে এই খবর পৌঁছলে তিনি কেল্লা ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সেই আদেশ অমান্য করে। মীরজাফর প্রচুর সৈন্য নিয়ে এসে কাশিপুরে তাঁবু ফেলেন। বাগবাজারে পেরিনস গার্ডেনে যুদ্ধ হয়। তখন কুমোরটুলির গোবিন্দ রাম মিত্র, বনমালী সরকার, গোকুল চন্দ্র মিত্র ও রাজা নব কৃষ্ণ নিজেদের ধন দৌলত বাঁচাতে বড় বড় গাছ কেটে চিৎপুর রোডে ব্যারিকেড তৈরি করেছিলেন। ফলে সিরাজের সৈন্যরা বাগবাজার দিয়ে কলকাতায় প্রবেশ করতে পারেননি।

 

বাংলার অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে নুন সেই সময় অন্যতম প্রধান পণ্য হিসেবে বিবেচিত হত। নীল চাষীদের মত মলুঙ্গিরাও ঠিকাদার  ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে দাদন নিয়ে নুন তৈরি করত। দাদন নেবার ফলে ঠিকাদার ও ব্যবসায়ীরা যে দাম বেঁধে দিত সহায়-সম্বলহীন মলুঙ্গীদের সেই দামেই নুন দিতে হতো। অথচ ব্যবসায়ীরা সেই নুন চড়া দামে বিক্রি করতো। এমনিতেই নুনের দাম অন্যান্য পণ্যের চেয়ে যথেষ্ট কম। তার ওপর এই শোষণ। এভাবেই নুন ব্যবসায়ীরা হয়ে উঠেছিল বিত্তবান।  গোকুল চন্দ্রের বাগবাজারের বাড়ি এক প্রকার সেই সাক্ষ‍্য বহন করে।

 

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি  চব্বিশ পরগণার জমিদারি পাওয়ার পর ধীরে ধীরে অবস্থা বদলাতে লাগে।। অবশ্য মলুঙ্গীদের দুঃখ-দুর্দশার নিরসন হয়নি তাতে। চব্বিশ পরগণা নুন উৎপাদনকারী জেলা। ১৭৬২ সালে কোম্পানির সাহেবকর্মীরা বুঝতে পারলেন নুনের ব্যবসা লাভজনক। এই ব্যবসা নিজেদের হাতে নিলে তাতে আখেরে লাভ হবে। ওয়ারেন হেস্টিংস তখন কমিটি অফ নিউ লঞ্চের সদস্য। ব্যবসায়ীদের হাতে রাখার জন্যও তিনি ওই পরিকল্পনায় আপত্তি জানিয়েছিলেন। কিন্তু ১৭৬২ সালে চব্বিশ পরগনার নুনের জমি ও অন্যান্য চাষের জমি ভোগ দখলের ক্ষেত্রে পার্থক্য করা হলো। এতদিন পর্যন্ত নুনের জমি ও চাষের জমির খাজনা ছিল এক। তারপর থেকে নিলামের মতো ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছিল। দর হেঁকে যে সবচেয়ে বেশি টাকা দেবে তাকেই নুনের জমি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বহুদিন পর্যন্ত নুনের জমি গভর্নর জেনারেল ও কাউন্সিলের রাজস্ব দপ্তরের অধীনে ছিল। ব্যবসায়িক সম্ভাবনা বিচার করে তা বাণিজ্য দপ্তরের অধীনে আনা হয়। ১৭৭২ সালে ওয়ারেন হেস্টিং ভারতের গভর্নর নিযুক্ত হন। নুনের চোরা চালান, অবৈধ মুনাফা ইত্যাদি বন্ধ করার জন্য ওই বছর ৭ই অক্টোবর তিনি নুনের কাজ-কারবার কোম্পানির একচেটিয়া করে দিলেন। এই একচেটিয়া ক্ষমতাবলে ঠিকাদার কোম্পানির হয়ে নুন তৈরি করতো। তারপর তারা বাঁধা দামে দিত কোম্পানিকে। কিন্তু এসব কিছুর পরেও মলুঙ্গিদের ওপর অত্যাচার কিন্তু কমেনি।

 

বালি থেকে মারাঠা এবং বর্গী হামলার ভয়ে গোকুল মিত্র পিতা সীতারাম মিত্রের সঙ্গে কলকাতায় পালিয়ে এসেছিলেন। অল্প সময়ের মধ্যেই নুনের ব্যবসা করে তিনি বিত্তবান হয়ে উঠেন। সৌভাগ্যের বিষয় ইংরেজদের সঙ্গেও তাঁর সম্পর্ক ভালো ছিল। তৎকালীন কলকাতায় এদের মত বিত্তবান অনেক বাঙালিরাই ইংরেজদের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করেছিলেন বিভিন্ন ব্যবসার মাধ্যমে। অর্থনৈতিক ক্ষমতার সঙ্গে বেঁধে নিয়েছিলেন রাজনৈতিক ক্ষমতার গাঁটছড়া। রাজা নবকৃষ্ণ ছিলেন গোকুল চন্দ্রের সমসাময়িক। দুজনে পরামর্শ করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে খাস কলকাতা, ডিহি কলকাতা ও চব্বিশ পরগণা ইজারা চেয়েছিলেন। যথাযথ খাজনাও দিতে চেয়েছিলেন তার জন্য। লর্ড ক্লাইভ তাদের সেই আবেদন স্বীকার করেননি। তিনি জানিয়ে দিয়েছিলেন গোকুল চন্দ্র ও নবকৃষ্ণ দুজনেই কলকাতার মধ্যে যথেষ্ট প্রভাবশালী এবং আর্থিক দিক থেকে বিত্তশালী। সেইসঙ্গে তাঁদের লোকবল যথেষ্ট। সুতরাং ক্ষমতা পেলে তারা প্রজাদের ওপর অত্যাচার করতে পারেন। ফলে কোম্পানির প্রজাদের ভুগতে হবে।

 

গোকুল চন্দ্র মিত্রের ভাগ্য ছিল সুপ্রসন্ন। ১৭৮৪ সালে কলকাতার লটারি কমিটি গঠিত হয়। রাস্তা তৈরি, পুকুর খনন করা ইত্যাদি উন্নয়নমূলক কাজের জন্য এই কমিটি গড়া হয়েছিল। লটারির টিকিট কিনে যারা জিততেন তাঁরা হিরা-চুনির গয়না অট্টালিকা, জমি ও সম্পত্তি পেতেন। গোকুল চন্দ্রের ভাগ্যে উঠেছিল চাঁদনী চক। কথিত আছে বিষ্ণুপুর থেকে মদনমোহন দেবতা তার বাড়িতে এসে ওঠার পর তিনি কলকাতার অন্যতম ধনী ব্যক্তি হয়ে ওঠেন। গোকুলচন্দ্র বাগ বাজারের অন্যতম নামী লোক ছিলেন। তাঁর বাড়িটিকে অনেকেই রাজপ্রাসাদের সঙ্গে তুলনা করেছেন।

 

১৮০৮ সালে গোকুলচন্দ্রের মৃত্যু হয়। তার সেই প্রাসাদতুল‍্য বাড়ির আজ যা অবস্থা তাতে কোনমতেই তাকে আর কলকাতার অন্যতম বনেদী বাড়ি বলা চলে না। কিন্তু তার বাড়ির সঙ্গে একই চত্বরে থাকা মদনমোহনের মন্দিরটি অক্ষত এবং আজও অদ্ভুতভাবে উজ্জ্বল। এই বাড়ি ঠিকানা ১৬১ আপার চিৎপুর রোড। ২৫২ বিঘা জমি নিয়ে এই বাড়িটি তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু এখন এক বিঘা ও কয়েক কাটা জমির উপর বাড়িটি দাঁড়িয়ে রয়েছে। দোতলা বাড়ি। প্রধান প্রবেশপথ দিয়ে ঢুকে বাঁদিকে চওড়া সিঁড়ি কয়েক পা ঘুরে দোতলায় উঠেছে। শ্রীহীন মলিন বাড়িটির গায়ে লেগে রয়েছে মৃত্যুর ছাপ। বাড়িটির বর্তমান অবস্থা অতীতের স্মৃতির কথাই কেবল মনে করায়। বাড়িটির গায়ে অযত্নের ছাপ সুস্পষ্ট। মদনমোহনের রাস মঞ্চ, মন্দির এগুলির গায়ে পলেস্তারাপড়েছে। ধুলো আর মাকড়সার জাল ছেয়ে গেছে। তবুও কলকাতার বুকে যে সকল বাড়ি ইতিহাসের নিদর্শন নিয়ে বেঁচে রয়েছে গোকুল চন্দ্র মিত্রের বাড়ি তার মধ্যে অন্যতম।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...