ত্রিপুরা হাউস: রবীন্দ্রনাথ ও জগদীশচন্দ্র বসুর স্মৃতিধন্য, কলকাতার রাজকীয় বনেদিয়ানা ও সংস্কৃতির ঐতিহ্য

কলকাতার বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে অবস্থিত ত্রিপুরা হাউসের এতটা উজ্জ্বল হওয়ার পিছনে অনেকটা কারণ এর দরজায় বাঁধা গাড়ির মডেলটি। একটা মার্সিডিজ বেঞ্জ। যা এই বনেদি বাড়িটিকে আলাদা মর্যাদা দান করেছে। তবে এই বাড়িটি পুরনো ত্রিপুরা হাউজের নব সংস্করণ । শোনা যায় নতুন এই প্রাসাদটি তৈরি হয়েছে বর্তমান শতাব্দীর তিরিশ-এর দশকের শুরুর দিকে। গম্বুজওয়ালা প্রাসাদ। মাঝখানের বড় গম্বুজ ঘিরে চারপাশে রয়েছে ছোট ছোট আরো চারটি গম্বুজ। প্রাসাদটি তৈরি হয়েছে ত্রিপুরাধিপতি মহারাজ বীর বিক্রম কিশোর মানিক্য বাহাদুরের নকশায়। স্থাপত্য বিষয়ে এই মহারাজ চর্চা করতেন রীতিমতো। ত্রিপুরার রাজারা বরাবর রুচিশীল এবং সংস্কৃতিমনস্ক। সৌখিনও বলা যেতে পারে।

কলকাতায় প্রাসাদ তৈরি করাটা ছিল সে সময় রাজাদের শখ। শুধু ত্রিপুরার রাজপরিবার নয়, অন্যান্য অনেক রাজাও কলকাতায় এমন প্রাসাদ তৈরী করেছেন।

ত্রিপুরার রাজ পরিবারের সঙ্গে সংস্কৃতি এবং বিজ্ঞান জগতের বিশেষ যোগাযোগ ছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর সঙ্গে এই পরিবারের গভীর ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। জগদীশচন্দ্র বসুর বিজ্ঞান গবেষণায় এই পরিবার প্রভূত সাহায্য করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে এদের সম্পর্ক যে কতটা ঘনিষ্ঠ ছিল তা ত্রিপুরার মহারাজা বীর বিক্রম কিশোর মানিক্য বাহাদুরের একটি ভাষণ থেকেই বোঝা যায়। রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনে কলকাতায় টাউন হল প্রাঙ্গণে রবীন্দ্রজয়ন্তীর শিল্প প্রদর্শনী ও মেলার উদ্বোধন করে তিনি তার ভাষণে বলেছিলেন " উদীয়মান রবির তরুণ সৌন্দর্যের ছটায় আমার প্রপিতামহ  স্বর্গীয় বীর চন্দ্র মানিক্য আকৃষ্ট হইয়াছিলেন। তদবধি কবিবরের সহিত আমাদের বিশেষ সম্বন্ধ। পিতামহ রাধা কিশোর মানিক্যও তাঁর পরম বন্ধু ছিলেন এবং পিতৃদেব বীরেন্দ্র কিশোর মানিক্য সেই সম্পর্ক অক্ষুন্ন রাখিয়াছিলেন।" সাহিত্যের এই মহান আকাশের বিষয়ে ত্রিপুরার রাজারা বরাবর উচ্চ-ধারণা পোষণ করতেন।

ত্রিপুরা হাউসের পরিবেশ যথেষ্ট সুন্দর, ছিমছাম এবং পরিচ্ছন্ন। এই বাড়ির স্থাপত্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তার সহজ-সরল ভাবের জন্য। একতলা বারান্দা কাম সিটিং রুমে রয়েছে তামার বিরাট চিনা ঘন্টা, যার কাঠের ফ্রেমে অপূর্ব নকশা রয়েছে। সারা বাড়িতে চিনা পোর্সেলিন-এর অজস্র জিনিস ছড়িয়ে রয়েছে। নীচের তলায় কাঠের মেঝের একটি ঘরে চিনা কাঠ-খোদাইয়ের কাজও দেখা যায়। বিভিন্ন রঙিন টুকরো-টুকরো পাথর দিয়ে তৈরি নকশাও দেখা যায়। চীনা প্রাচীন বুদ্ধ মূর্তি দেখা যায়।

নীচের রঙিন ডাইনিং রুমে এই পরিবারের  আইনজীবীদের আঁকা আটটি বড় ছবি রয়েছে। ত্রিপুরার রাজ পরিবারের আইনজীবীরা আঁকতে বড় ভালোবাসতেন, ছবিগুলি তার সাক্ষ্য বহন করে।‌ গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত, বসন্ত এই ছটি ঋতুকে কেন্দ্র করে ছবিগুলি আঁকা হয়েছিল।


ত্রিপুরা হাউস কলকাতার বনেদিয়ানাকে নানা ভাবে রক্ষা করেছে। তবে শুধুমাত্র সাবেকি বনেদিয়ানা নয়, কলকাতার শহরে ক্রমাগত প্রবেশ করতে থাকা পাশ্চাত্য সংস্কৃতিকেও ধরে রেখেছিল এই পরিবারের মানুষজন। বড়দিনে আগে জমকালো পার্টি দেওয়া হত এখানে। ভারতের নানা প্রান্ত থেকে রাজারা এই পার্টিতে যোগ দিতে আসতেন। সেসব ছবিও পাওয়া যায়।

বাড়িটি যথেষ্ট রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। এখানে আজও সংস্কৃতি চর্চা করা হয়। ত্রিপুরা হাউজের উত্তরসূরিরা এই ভবনের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতন। তা রক্ষা করে চলেছেন সযত্নে। মূলত ত্রিপুরার অধিবাসী তাঁরা। তবে বুকের মধ্যে কলকাতাকেও ধরে রাখেন।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...