দেশের প্রতি আত্মনিবেদনেই আত্মোপলব্ধি হয়েছিল তাঁর

১৮৭৮ সাল। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির উঠোন। একটি ছয় বছরের বালিকার হৃদয় জুড়ে উথাল- পাথাল। কারণ সেদিন তাঁরই সমবয়সী এক মেয়ে তাঁকে ভয় দেখিয়েছিল যে কখনো কোন পাপ করলে তাকে একেবারে একা বেঁচে থাকতে হবে, এটাই নাকি শাস্তি। ছয় বছরের সেই বালিকাটি সেদিন ছাদে উঠে দিগন্তরেখার দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তাঁর শিশুমন কল্পনা করতে লাগল যেন কোথাও কেউ নেই, আকাশে পাখি নেই, বাড়িতে আপনজনেরা নেই, এমনকি ইঁদুর পিঁপড়েরাও নেই। ব্রহ্মাণ্ড একেবারে শূন্য। শুধু মেয়েটি একা আছে। ‌ ওই শিশুমন সেদিন নিঃসঙ্গ বোধ করেনি। আকাশকে তাঁর বন্ধু মনে হয়েছিল। প্রকৃতির আলো- আঁধারকে বড় আপন লেগেছিল। স্রষ্টার সঙ্গে একাত্মবোধএর অনুভূতি হয়েছিল ওই বয়সেই। নিঃসঙ্গতার ভয় যেন দিগন্তরেখায় বিলীন হয়ে গেল। পরে সেই বালিকা তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন " সেদিন আমার মনের সেই স্বাবলম্বন কোথা হইতে আসিল তাই ভাবি, বোধহয় তাহা সহজাত হইবে, শিক্ষালব্ধ নয়"। এমনই একজন সাহসী, চেতনাবোধে উদ্দীপ্ত মানুষ ছিলেন সরলা দেবী চৌধুরানী।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ভাগ্নী সরলা দেবী জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৮৭২ সালের ৯ই সেপ্টেম্বর জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে। মাতা স্বর্ণকুমারী দেবী ও পিতা জানকীনাথ ঘোষালের কনিষ্ঠা কন্যা তিনি। স্বর্ণকুমারী দেবী সে যুগেও সংস্কৃত, বাংলা এবং ইংরেজি ভাষায় বিদূষী ছিলেন। তাঁর শিক্ষা ও বোধ সঞ্চারিত হয়েছিল কন্যা সরলা দেবীর মধ্যেও। শিশু বয়স থেকেই তাঁর অন্তরে সহজাত স্বাবলম্বনের দৃঢ়তা ছিল। আর ছিল দেশের প্রতি ভালোবাসা, যা তাঁকে তেজস্বিনী, মহীয়সী করে তুলেছিল। সে সময় মেয়েদের জীবন সাধারণত অন্তঃপুরেই কাটত। ঠাকুরবাড়ি এ বিষয়ে যদিও খানিক ব্যতিক্রম ছিল। তবে সাধারনত যা ঘটত তাও বহাল তবিয়তেই সমাজে উপস্থিত ছিল। সেই পরিস্থিতিতেও ১৮৮৬ সালে ১৩ বছর বয়সে সরলা দেবী এন্ট্রান্স ও ১৮৯০সালে ১৭বছর বয়সে ইংরেজি অনার্স সহ বি.এ. পাস করেন।

বাঙালি জাতির প্রতি সরলা দেবীর ভালোবাসা ছিল অমলিন। তাঁর আত্মজীবনী 'জীবনের ঝরাপাতা'য় তিনি লিখেছিলেন "বাঙালি জাতি সম্বন্ধে আমার আত্মাভিমান গভীর, এই জাতির সকল রকমের বিস্তারের প্রচেষ্টা আমি করেছিলুম"। বিংশ শতাব্দীর প্রথম থেকেই তিনি বাঙালি জাতির মধ্যে শরীরচর্চায় উৎসাহ দেবার লক্ষ্যে ব্যায়াম চর্চার ব্যবস্থা করেছিলেন কুস্তিগীর ও পালোয়ানদের কাছে। দেশাত্মবোধ প্রসারের জন্য মারাঠাদের 'শিবাজী উৎসব'এর অনুকরণে তিনি ১৯৩০ সালে কলকাতায় 'প্রতাপাদিত্য উৎসব' এর প্রচলন করেন। বিদেশি দ্রব্য বর্জনের জন্য সব সময় উৎসাহ দিতেন তিনি। তাঁর বীরাষ্টমী ব্রতর উদ্দেশ্য ছিল বাংলার যুবকদের শারীরিক ও মানসিক শক্তিকে জাগ্রত করা। দেশ সেবার কাজে তিনি সর্বদা অগ্রসর ছিলেন। ১৯০২ সালের শেষের দিকে বরোদা থেকে অরবিন্দ ঘোষের চিঠি নিয়ে যতীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এসেছিলেন সরলা দেবীর কাছে 'বিপ্লবী গুপ্ত সমিতি' স্থাপনের উদ্দেশে। তাঁকে সর্বতোভাবে সাহায্য করেছিলেন তিনি। সরলা দেবী সুলেখিকা, সুগায়িকা এবং সুরকার ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের অনুরোধে বন্দেমাতরম্ গানের প্রথম সুর সরলা দেবীই দিয়েছিলেন। সরলা দেবী ভারতী পত্রিকার সম্পাদিকা ছিলেন ১৩০২-১৩০৪,১৩০৬-১৩১৪,১৩৩১ থেকে আশ্বিন ১৩৩৩ বঙ্গাব্দ পর্যন্ত। তিনি কংগ্রেসের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিবিড় ভাবে যুক্ত ছিলেন। ১৯০১ সালে কলকাতার কংগ্রেস অধিবেশনে তাঁর নিজেরই রচিত গান গেয়েছিলেন "অতীত গৌরবকাহিনী মম বাণী, গাও আজি হিন্দুস্থান"। তাঁর সেই গান সভার প্রতিটি মানুষের মনে দেশের জন্য মরণের স্পৃহা জাগিয়ে তুলেছিল। ১৯৪৫ সালের ১৮ই আগস্ট তাঁর জীবনাবসান হয়। তাঁর জীবন আলোর মতো আজও সুচিন্তার পাথেয় হয়ে রয়েছে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...