কোন পুণ্য কর্মে মহাপ্রভুকে সন্তান রূপে পেয়েছিলেন শচী দেবী?

ভগবানকে সন্তান রূপে পেতে গেলে এক দীর্ঘ এবং গভীর তপস্যার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। যারা যারা ভগবানকে নিজে গর্ভে ধারণ করেছেন, তারা কেউই এর ব্যতিক্রম নন। ঠিক একইরকম ভাবে কলিযুগের অবতার শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুর পিতা ও মাতা জগন্নাথ মিশ্র এবং শচী দেবীর পূর্বজন্মের ঘটনাও রয়েছে ভবিষ্য পুরাণে। সেই ভবিষ্য পুরাণ অনুযায়ী জানা যায় পূর্ব জন্মের কোন কর্মফলে তারা পরজন্মে ভগবানকে সন্তান রূপে পেয়েছিলেন। আজকে সেই ঘটনাই বলব।

অনেকদিন আগে ভারতবর্ষে একজন নিরঅহংকারী, সদাচারী, মিষ্টভাষী, সু-পন্ডিত ব্রাহ্মণ বাস করতেন। তার নাম ছিল বিষ্ণু শর্মা। তার স্ত্রীও  ছিলেন স্বামীর মতই ধার্মিক এবং সদাচারী। তিনি সর্বদা স্বামীর কথা মেনে চলতেন। ভিক্ষাই ছিল তাদের প্রধান জীবিকা। এছাড়া তাদের জীবনে আর অন্য কোন‌ও সংস্থান ছিল না। রোজ ব্রাহ্মণ ভিক্ষা করতে বেরোতেন আর ব্রাহ্মণী ঘরে বসে হরিনামের মালা জপ করতেন। এরকমই একদিন ব্রাহ্মণ প্রতিদিনের মত ভিক্ষা করতে বেরিয়েছেন সেই সময় ব্রাহ্মণী কুটিরের মধ্যে থেকে দেখলেন একজন জটাজুটধারী সন্ন্যাসী কুটিরের দ্বারপ্রান্তে এসে ভিক্ষা চাইছেন। ব্রাহ্মণী ভাবলেন সন্ন্যাসীকে কী দিয়ে আপ্যায়ন করবেন তিনি?! তার ঘরে তো কিছুই নেই! তিনি নিজেও একটি শতছিন্ন শাড়ি রয়েছেন , যেটা পরে কুটিরের বাইরে আসতেও তার লজ্জা করছে। তখন তিনি ভেতর থেকেই বললেন, আসুন, দয়া করে বসুন এই পিঁড়িতে‌। আমার স্বামী ভিক্ষা করতে বেরিয়েছেন, উনি ভিক্ষা করে ফিরে এলে আমি আপনার জন্য খাদ্য প্রস্তুত করে দেব, আপনার সেবার ব্যবস্থা করব, তবে এখন আপনি হাত মুখ ধুয়ে একটু জলসেবা করুন।


সন্ন্যাসী ঠাকুর বুঝতে পারলেন, এরা সত্যি অত্যন্ত দরিদ্র। তিনি ভাবলেন দীর্ঘদিন তপস্যা করে যে স্পর্শ মনি আমি পেয়েছি তাই দিয়ে এই কুটির বাসিনীকে যদি ধনী করে তুলি, তাতে মন্দ কী? দারিদ্র্যের জ্বালা আমি বুঝি। সেই জ্বালা দূর করবার জন্য শিবের আরাধনা করে এই স্পর্শ মনি পেয়েছি। সেই মনি বরং এদের কাজে লাগুক। তারপর সন্ন্যাসী ব্রাহ্মণীকে বললেন, আমার বড় ক্ষুধা মা, ৩০ বছর অনাহারে থেকে শিবের বরে আমি একটি স্পর্শ পাথর পেয়েছি, গৃহে ফিরতে আমাকে অনেক পথ যেতে হবে‌। তাই ভাবলাম তোমার কুটিরেই কিছু আহার করি। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য তোমাদের এমন দুর্দশা যে সামান্য কিছু আহারও বাড়িতে নেই। কী আর করা যাবে? বেশ তোমার স্বামী গৃহে ফিরতে ফিরতে আমি বরং  স্নান সেরে আসি। এক কাজ কর মা, তোমার বাড়িতে যত লোহা আছে এই স্পর্শ মনি দিয়ে সব সোনা করে নাও, তোমাদের দুঃখ ঘুচবে আর ভিক্ষা করে খেতে হবে না। 


এই বলে সেই স্পর্শমনিটি সন্ন্যাসী ব্রাহ্মণীকে দিতে চাইলে তিনি সেটি নিজের হাতে না নিয়ে শুধু বললেন, ওখানে মাটিতেই নামিয়ে রেখে দিন। সেটি রেখে সন্ন্যাসী স্নানের জন্য চলে গেলেন। ব্রাহ্মণী তখন চিন্তা করলেন, আমরা গরীব , ভিক্ষা ছাড়া আর কোন সংস্থান আমাদের নেই,  ব্রাহ্মণ বুড়ো হয়েছেন আর কতদিন ভিক্ষা করবেন? আমাদের কোন‌ও ছেলেপুলেও নেই যে শেষের দিনে আমাদের দেখবে। এই পাথরের দ্বারা আমরা যদি বড়লোক হতে পারি তাহলে আমাদের আর কোনও চিন্তা থাকবে না। আবার তিনি পরক্ষণেই ভাবলেন, নাহ, স্বামী আগে ফিরে আসুন, তিনি যা বলবেন তাই হবে। আমি না হয় তাকে বুঝিয়ে বলব, যদি তিনি স্বীকার করেন তো ভালই, নাহলে সন্ন্যাসীর জিনিস তাকেই ফিরিয়ে দেব। এইরকম নানান রকম ভাবনা চিন্তা করছেন ব্রাহ্মণী, সেই সময় ভিক্ষা করে ব্রাহ্মণ ফিরে এলেন কুটিরে।


ব্রাহ্মণী সন্ন্যাসী ঠাকুরের সব কথা তাকে বললেন সেই সবকথা শুনে ব্রাহ্মণ বললেন ওসব পাপের জিনিস ব্রাহ্মণী, ওসব ঘরে রাখতে নেই। ওসবে কী হবে? বড়লোক হয়ে কী হবে?  এই তো বেশ আছি। ভগবান আমাদের ভাগ্যে যা দিয়েছেন তার বেশি কিছু আশা করা উচিত নয়। যখন আমি অসুস্থ বা শয্যাশায়ী হয়ে পড়ব আর ভিক্ষায় যেতে পারব না, গোবিন্দই তখন আমাদের দেখবেন। আমাকে মনি টি দাও, আমি নদীতে ফেলে দিয়ে আসি। ব্রাহ্মণী এই কথাতে বাধা দিয়ে বললেন, নাহ, সেটা করা উচিত হবে না। আমরা গরীব, তাতে কোনও ক্ষতি নেই কিন্তু সন্ন্যাসী ঠাকুর যখন এই মনিটি চাইবেন তখন কী উত্তর দেব? ব্রাহ্মণ বললেন, তখন যা হয় দেখা যাবে। আগে গিয়ে তো নদীতে ফেলে দিয়ে আসি। ব্রাহ্মণী আর কোনও প্রতিবাদ করলেন না। ব্রাহ্মণ মনিটি নদীতে ফেলতে চলে গেলেন।


সন্ন্যাসী স্নান করে এসে দেখলেন, ব্রাহ্মণের কুঠিরে কোনও সোনা নেই, লোহার টুকরোগুলো তেমনি পড়ে আছে। তিনি ব্রাহ্মণীকে জিজ্ঞেস করলেন, কই আমার স্পর্শ মনিটা দাও আর তোমাদের বাড়ির কোনও লোহাকেই তো সোনা করে নাওনি দেখছি‌। ব্রাহ্মণী তখন ধীরে ধীরে উত্তর দিলেন, আমার স্বামী ওসব পছন্দ করেন না,তাই তিনি মনিটি নদীতে  ফেলে দিয়েছেন। এই কথা শুনে সন্ন্যাসী কাঁদতে শুরু করলেন আর গভীর দুঃখে বলতে লাগলেন, হায় হায় এ আমার কী সর্বনাশ হল গো ? ৩০ বছর কঠোর সাধনা করে যে মনি পেলাম,  তার গুরুত্ব না বুঝে সেটিকে নদীতে ফেলে দিলে?  এই বলে সন্ন্যাসী গড়াগড়ি দিতে লাগলেন মাটিতে। 


এই সময় ব্রাহ্মণ ফিরে এসে সন্ন্যাসীর সেই কান্নার দৃশ্য দেখলেন। ব্রাহ্মণকে দেখে সন্ন্যাসী মেঝে থেকে উঠে পড়ে বললেন, তুমি আমার এ কী সর্বনাশ করলে? আমার শিবদত্ত মনিকে তুচ্ছ জ্ঞান করলে তুমি? তুমি কী করে বুঝবে স্পর্শ মনির গুণ? তোমাদের দুঃখ কষ্ট দেখে করুণা হওয়ায় তোমাদের স্পর্শমনিটি দিয়ে গেলাম আর তুমি ভিক্ষুক হয়ে সেটি নদীতে ফেলে দিয়ে এলে?


সন্ন্যাসীর দুঃখ দেখে ব্রাহ্মণ বললেন, আপনার যখন এত প্রয়োজন মনিটির, তাহলে আবার কুড়িয়ে নিলেই হবে। আমার সঙ্গে চলুন ঘর্ঘরা নদীতে সেখান থেকে মনিটি কুড়িয়ে দেব। সেই নদীতে গিয়ে ব্রাহ্মণ অল্প জলে নেমে মনিটি কুড়িয়ে দিলেন আর  বললেন , এই নিন আপনার সেই মনি। মনিটি হাতে নিয়ে সন্ন্যাসী বললেন,  এটা তো সেই মনি নয়, শিব প্রদত্ত স্পর্শ মনিটি ছিল বেশ ছোট, এটা তো দেখছি বেশ বড়। তুমি কি আমাকে বালক ভেবেছ? কাঁচকে হীরা বলছ। 

সন্ন্যাসী বললেন , সেই মনিটি কোন‌ও লোহাতে ঠেকালে সেটি সোনা হয়ে যাবে। ব্রাহ্মণ তখন বললেন, আপনি লোহা এখানে কোথায় পাবেন? এক কাজ করুন, কত নুড়ি পাথর পড়ে আছে এখানে, তাতে একটু ছুঁয়ে দেখুন না। 

সন্ন্যাসী অবহেলা ভরে একটি পাথরে মনিটি ঠেকাতেই সেটি উজ্জ্বল সোনায় পরিণত হল, পাশে ছিল কয়েকটি কাঁটা গাছ। সেই গাছগুলিও মনির স্পর্শ সোনা হয়ে গেল। এসব দেখে সন্ন্যাসীর চৈতন্য হল, সব দেখে   অবাক হয়ে তিনি ভাবলেন শিবদত্ত  মনি তো শুধুমাত্র লোহাকে সোনা করতে পারে কিন্তু এই মনি টি গাছ,  নুড়ি , পাথরকে সোনা  করছে কীভাবে? এই ব্রাহ্মণ কে? যিনি ইচ্ছা করলে অসীম সম্পদের অধিকারী হতে পারেন অথচ তার মনে বিন্দুমাত্র লোভ নেই। ভিক্ষা ই যার সম্বল, না এই ব্রাহ্মণ সাধারণ নন,  এই ব্রাহ্মণ নিশ্চয়ই এমন কিছু জানেন, যার সন্ধান অন্য কেউ জানেন না। 


সন্ন্যাসী মনিটি  ঘর্ঘরা নদীর জলে ফেলে দিয়ে ব্রাহ্মণের পায়ে লুটিয়ে পড়ে বললেন, আপনি প্রকৃত ধনী, তা না হলে এই প্রার্থিব ধনকে এমন করে অবহেলায় ছুঁড়ে ফেলতে পারতেন না, দয়া করে আমাকে আপনার গোপন ধনের এক কনা দিন। 

বিষ্ণুর উপাসক সেই ব্রাহ্মণ তখন বললেন, বিষ্ণুভক্তির কথা। তিনি বললেন, এ জগতে বিষ্ণু ছাড়া বড় ধন আর কী আছে? তাকে আশ্রয় করে নির্বিকার চিত্তে তার শরণ নিলে কোনও অভাব থাকে না।


সন্ন্যাসীকে ব্রাহ্মণ বিষ্ণুমন্ত্র দীক্ষা দিলেন। এরপর ব্রাহ্মণ ও ব্রাহ্মণী বিষ্ণুর তপস্যায় বসলেন। সেই তপস্যাতে সূর্য মন্ডল উত্তপ্ত হয়ে উঠল, চঞ্চল হয়ে উঠল দেবলোক, ব্রাহ্মণ  ব্রাহ্মণী কী চাইলেন? ব্রাহ্মণ ও ব্রাহ্মণী মনে মনে চাইলেন, মানুষকে খেলনা দিয়ে ভুলিয়ে না রেখে তাদের চৈতন্য দাও প্রভু, তারা তোমাকে যেন ভুলে না যায়। কলির মোহ ফাঁদে যেন পা না দেয়। স্বর্গের কশ্যাপ অদিতি, অযোধ্যার দশরথ কৌশলা, মথুরার বসুদেব দেবকী ই  নবদ্বীপে জগন্নাথ মিশ্র আর শচী দেবীরূপে জন্মগ্রহণ করলেন আর এই ব্রাহ্মণ ব্রাহ্মণী তাদেরই শরীরে  মিশে গেলেন। এরপর শচীদেবীর ঘর আলো করে  জগতের সকল জীবকে হরিনামে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে শ্রী গৌরহরি আবির্ভূত হলেন।


দেবতারা স্তব গান করতে লাগলেন, হে শচীনন্দন তুমি যুগে যুগে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়েছ, কখনও নরসিংহ রূপে, কখনও মৎস্য  রূপে, কখনও বরাহ রূপে, কখনও আবার বামন রূপে। বারবার পৃথিবীতে এসে পৃথিবীকে উদ্ধার করেছ,  মানুষকে উদ্ধার করেছ, কলির মানুষরা এখন স্রষ্টাকে অস্বীকার করছে, তারা আত্মজ্ঞানহারা হয়ে নিজেরাই নিজেদের সর্বনাশ ডেকে আনছে। মোহ, মায়া জালে তারা আবদ্ধ। তুমি তাদের রক্ষা করও, জগতকে চৈতন্যদান কর, শ্রী কৃষ্ণ চৈতন্য নামে তুমি খ্যাতি লাভ কর। 


এই শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্যই মহাপ্রভু। মহাপ্রভু ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রী রাধার ভাবকান্তি অঙ্গীকার করে নবদ্বীপে অবতীর্ণ হন, অল্প বয়সেই তিনি পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। বিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাসী হয়ে তিনি প্রেম ধর্ম প্রচার করেন। সব রকম বিভেদ প্রেমের বন্যায় ভাসিয়ে একাকার করে দেন তিনি মানুষকে।

 

তথ্যসূত্রঃ ভবিষ্য পুরাণ 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...