মা কামাখ্যার সঙ্গেই কামাখ্যাগুড়িতে পূজিত হন দেবী বসমতী

আলিপুরদুয়ার জেলার মধ্য কামাখ্যাগুড়ি। এখনো জনজাতির মানুষরা বসবাস করেন এখানে। বৃষ্টি না এলে তাঁরা উদ্বিগ্ন হন। শহুরে আদব-কায়দা না জানা, পরিবেশের বিরাট ক্ষতি হয়ে যাওয়ার তথ্যভাণ্ডার না জানা মানুষগুলোর কাছে আষাঢ় মাস মানেই বর্ষাকাল। তাঁরা অপেক্ষা করতে থাকেন বৃষ্টির। মাটি তাদের কাছে লক্ষ্মী। এই দেবীর অর্থাৎ মাটির পুজো করার জন্য তাঁদের কোন মূর্তি প্রয়োজন হয় না। আষাঢ় মাসের ১১ তারিখের আগে চার দিন উপোস করেন তাঁরা তাদের ধরিত্রী মায়ের জন্য। আলিপুরদুয়ার জেলার মধ্য কামাখ্যাগুড়িতে বসবাসকারী স্থানীয় রাভা সম্প্রদায়ের লোকেরা এই সময় শুধু ফলমূল খায়। এই সময়টা ওরা মাটিকে বিশ্রাম নিতে বলে। কারণ বৃষ্টি শুরু হলে মাটি উর্বর হবে, তার ভেতর থেকে জন্ম নেবে নতুন ফসল। নতুন ফসল অর্থাৎ নতুন জীবন। ওরা জমিতে খুঁটি পুঁতে গবাদি পশু চরতে দেয় না। এরপর চারদিনের শুয়া বা উপোস শেষ হলেই আষাঢ়ের ১১ তারিখ স্থানীয় আদি মা কামাখ্যা ধামে মা কামাখ্যার সঙ্গে পুজো করেন মা বসমতীর। মা বসমতী এই অঞ্চলের মানুষের কাছে মাটির দেবী। তাঁরা এই মাটির দেবীকেই লক্ষ্মী হিসেবে মানেন।

মঙ্গলীয় জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত রাভা জনজাতির লোকেদের মধ্যে প্রচলিত বায়কোহো কিংবা মঙ্গলকায় আদতে ফারটিলিটিকাল্ট অর্থাৎ কৃষিভিত্তিক লোকাচার। উত্তরবঙ্গের কোচবিহার জেলার রসিক বিলের তাকওয়ামারির পাগলীকুঠি, ব্রজেরকুঠির কৃষক সম্প্রদায়ের লোকেদের মধ্যে মা বসমতী নামে একজন লৌকিক দেবীর পুজোর প্রচলন দেখা যায়।

Maa_kali

মা বসমতীর পুজো অর্থাৎ মাটির পুজো, ক্ষেতের পুজো। মা বসমতীকে ক্ষেতের লক্ষ্মী হিসেবে মানা হয়। রাভা জনজাতির লোকেরা চাষ শুরু করার আগে এবং ফসল কেটে ঘরে তোলার সময় মাটিতে অর্থাৎ চাষের জমিতে এই দেবীর উদ্দেশে পুজো দেয়। এই দেবীর বরে নাকি ফসল ভালো হয়। মূলত বাড়ির মহিলারা এই পুজো করেন। পুজোটা মূলত ক্ষেতের জমিতে হয়। পুজোর সময় বাড়ির মহিলার সঙ্গে বাড়ির একজন পুরুষও থাকতে পারে। সেই পুরুষ মহিলার স্বামী বা সন্তান যে কেউ হতে পারে। তবে কেবলমাত্র একজন। ফসল কাটার সময় মা বসমতীর জন্য যে পুজো দেওয়া হয় সেটা কিন্তু ফসল বোনার সময় যে পুজো হয় তার থেকে আলাদা। মূলত পৌষ মাঘ মাসে ফসল কাটার ঠিক আগে স্থানীয় রাভা সম্প্রদায়ের লোকেরা এই দেবীর উদ্দেশে আশীর্বাদ লাভের আশায় পুজো দিয়ে পাকা ফসল ঘরে তোলে। পুজো হয় গভীর রাতে।

সপ্তাহের শনিবার বা মঙ্গলবার দেখে বাড়ির মহিলা আর বাড়ির একজন পুরুষ খেতে যায়। বাইরের কারোর কিন্তু এই পুজো দেখার অনুমতি নেই। সারাদিন নিরামিষ খেয়ে সেই নারী গভীর রাতে স্বামী বা ছেলের সঙ্গে ক্ষেতে পৌঁছয়। পূজোর উপকরণ বলতে কদম ফুল, কদম ফুলের মালা, বাতি, কাস্তে, দুধ, কলা, চিনি, আতপ চাল আর যাত্রাসী গাছের পাতা। এছাড়া সিঁদুর, ধূপ, ধুনো আর মুরগি। দেবীর কোন মূর্তি তৈরি করা হয় না। চাষের জমির মধ্যেই পূজোর উপকরণ সাজিয়ে ভক্তি ভরে বাড়ির কর্ত্রী পুজো করেন। শুধুমাত্র ভালো ফসল তোলা এবং মাটির সুস্বাস্থ্য রক্ষা করাই এই পুজোর উদ্দেশ্য। বায়ু, অগ্নি, দিককে সাক্ষী রেখে মুরগিটা বলি দিয়ে মা বসন্ত থেকে উৎসর্গ করা হয়। এই বলি দেওয়া মুরগী পূজারী মহিলার খাওয়া বারণ। এই মুরগী রান্না করে প্রসাদ হিসেবে খেতে পারেন একমাত্র মহিলা পুজোর সঙ্গী সেই পুরুষ মানুষ। এরপর নিঃশ্বাস বন্ধ করে মা বসমতীর নাম করে কাস্তে দিয়ে এক মুঠো ধান কেটে সেই ধান আটি বেঁধে কুলোয় রেখে তার সঙ্গে বাতি দিয়ে মাটিতে রাখা হয়। এইসব শেষ করে ভোরবেলা মহিলাটি তার পরিবারের পুরুষ মানুষের সঙ্গে বাড়ি ফিরে যায়।

চাষ শুরু করার সময় আষাঢ় মাসেও মা বসামতীর উদ্দেশে পুজো করা হয়। সেটা দিনের বেলায় দেওয়া হয়। এই নিয়ম মেনেই পুজো করা হয়। এক্ষেত্রে তবে লাঙ্গল রাখা হয়। পুজোর সময় সেই মহিলার সঙ্গী পুরুষটি লাঙ্গল দিয়ে কিছুটা জমি ফাটিয়ে তারপর দেবী বসমতীর উদ্দেশে প্রার্থনা শুরু করেন। পুজোর শেষে এক্ষেত্রে দুটো বাতি জমিতে রেখে আসতে হয়।

তবে শুধু নিজের প্রয়োজনে ফসল নয় মা বসমতী দেবীকে পুজো করা হয় সকলের পাতে যাতে প্রয়োজনীয় অন্ন তুলে দেওয়া যায়।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...