বিপদসঙ্কুল পথে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর সাবমেরিন যাত্রার কথা শিহরিত করে আজও

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যখন শুরু হয়, সুভাষচন্দ্র বসু তখন জার্মানিতে ছিলেন। বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর জার্মানির শক্তি ক্রমশ ক্ষয় হতে শুরু করে। নেতাজী বুঝতে পারছিলেন এই সময় জার্মানিতে থাকা তাঁর জন্যে কিছুতেই নিরাপদ নয়। আজাদ হিন্দ ফৌজ গড়ার স্বপ্ন তখন তাঁর চোখে। তাঁর স্বপ্নের আজাদ হিন্দ ফৌজকে নিয়ে ভারতে ফিরতে গেলে তাঁকে যে করেই হোক দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যেতে হবে। কিন্তু সেই যাত্রাপথ কী হবে? বিমানে যাওয়া কোনভাবেই নিরাপদ নয়। সেই সময়কার পরিস্থিতিতে নেতাজীর পক্ষে বিমানে যাওয়া একেবারেই নিরাপদ ছিল না। তাহলে উপায়?

তিনি স্থির করলেন সাবমেরিনে যাবেন। যদিও বিপদের সম্ভাবনা যথেষ্ট ছিল সেখানে। ইংলিশ চ্যানেল, উত্তর সাগর, ভূমধ্যসাগর আটলান্টিক মহাসাগর সবকিছুই মিত্রবাহিনীর দখলে ছিল। কখন যে টর্পেডো বা কোন ভারী কামানের পাল্লায় পড়ে যেতে হবে তা নেতাজি নিজেও জানতেন না। তবুও সাহস করে সাবমেরিন যাত্রাপথকেই বেছে নিলেন।

এই যাত্রাপথের প্রথমার্ধই সবচেয়ে বিপদসঙ্কুল ছিল বলে মনে করা হয়েছিল। এই বিপদসঙ্কুল যাত্রাপথের দায়িত্ব নিয়েছিল জার্মান সরকার। জার্মান সরকারের তরফ থেকে নেতাজিকে দক্ষিণ আফ্রিকার সংলগ্ন মাদাগাস্কারের কাছাকাছি একটি স্থানে পৌঁছে দেওয়ার কথা হল। এরপর সুভাষ বসুর দায়িত্ব নেবে জাপান সরকার,,এমনটাই কথা হয়েছিল।

সাবমেরিন-এর যাত্রা শুরুর আগে সুভাষচন্দ্র বসুর কয়েকটি বক্তৃতা রেকর্ড করা হলো। তার অবর্তমানে এই রেকর্ডগুলো আজাদ হিন্দ রেডিও থেকে প্রচার করা হবে এটাই স্থির হয়েছিল। ব্রিটিশ মার্কিন শক্তিকে বিভ্রান্ত করার লক্ষ্যেই এই পরিকল্পনা করা হয়েছিল। নেতাজি জার্মানিতে রয়েছেন এই ভ্রান্তি সৃষ্টি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

সাবমেরিন-এ সুভাষ বোস কি একা যাবেন? স্থির হল একজন সঙ্গী দেওয়া হবে সুভাষচন্দ্র বসুকে। সুভাষচন্দ্র বেছে নিলেন আবিদ হাসানকে। হায়দ্রাবাদের এক তরুণ ছাত্র। সুভাষচন্দ্র বসুর সচিব ও তাঁর কাছের বন্ধু হিসেবে আবিদ হাসান সাবমেরিনে যাত্রা করলেন।

এছাড়াও জার্মান চালক দল সঙ্গী ছিলেন সাবমেরিন-এ। U-180 সাবমেরিনটি সুভাষচন্দ্র বসুর জন্য প্রস্তুত করা হয়েছিল। জার্মানি নেতাজিকে সম্মান করত, তাই কঠিন পরিস্থিতিতে পড়েও নেতাজির মত দেশনায়ককে উপযুক্ত সম্মান দিয়েছিল জার্মানি। ১৯৪৩ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারি সুভাষচন্দ্র বোসকে নিয়ে সাবমেরিনটি যাত্রা শুরু করে। জার্মানির কিল নৌবন্দর থেকে এই যাত্রা শুরু হয়েছিল। জার্মান সাবমেরিনটি সাবেকি ধরনের ছিল। এই সাবমেরিনটি ডিজেল ইঞ্জিন-চালিত ছিল। জলের তলায় একটানা ৪৮ ঘন্টার বেশি চলতে পারত না। শুধু তাই নয়, ব্যাটারিতে চার্জ দেওয়ার জন্য মাঝে মাঝে জলের ওপর ভেসে উঠত। সে এক বিপজ্জনক উত্থান। ভয় কাজ করছিল সকলের মনে। যে কোন মুহূর্তে এই উত্থানের সময় শত্রুপক্ষের নজরে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল।

অবিরাম ঢেউ ভাঙার শব্দের সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল সকলের ভয়ের হৃদস্পন্দন। গতিতেই চলছিল সাবমেরিন। এই যাত্রাপথ মোটেই কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। বরং কন্টকিত ছিল।

সুভাষচন্দ্র বসু ধরেই নিয়েছিলেন বিপদসংকুল এই পথের শেষ বোধ হয় হবে না তাঁর। তবে পিছিয়ে আসার মানুষ তিনি ছিলেন না। ব্রিটিশ রাজশক্তির বিরুদ্ধে সশস্ত্র আক্রমণ করার উপযুক্ত জায়গা ছিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া। আর সেখানে পৌঁছনোর ক্ষেত্রে তিনি সাবমেরিনকে বেছে নিয়েছিলেন।

সাবমেরিনে যাত্রা করার সময় ঘুমোতেন না কেউই। ছোট্ট কেবিনে সোজা হয়ে দাঁড়াবার উপায় ছিল না নেতাজীর। ক্লান্তি ঘিরে ধরত। রাতে তিন-চার ঘন্টার বেশি ঘুমোতেন না। নানা ধরনের পরিকল্পনার রূপরেখা তৈরি করতেন। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ইন্ডিয়ান স্ট্রাগলের সংশোধন-এর মধ্যে নিয়মিত কাজ ছিল।  দিন কাটত সেই সাবমেরিনে বসেই। সাবমেরিন -এর সবকিছুই বৈচিত্র্যহীন। খাওয়া-দাওয়া স্বাদহীন। তবুও এমন দিনযাপনকে নেতাজী নিজেই বেছে নিয়েছিলেন।

স্বাধীনতার শৃংখল ভাঙার জন্য সাবমেরিনে বসে অনেক পরিকল্পনা করেছিলেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু। বিপদেও পড়েছিলেন বেশ কয়েকবার। কখনো সাবমেরিন শত্রুর জালে আটকে পড়েছে। সকলের মধ্যে উৎকণ্ঠার ছাপ দেখা গেছে। তবে নেতাজি ভয় পাননি। নির্দিষ্ট পথে এগিয়ে গেছেন। তারপর দুমাস পরে মাদাগাস্কার উপকূলে একটা পেরিস্কোপ দেখা যায়। স্পষ্ট সংকেত। জার্মান সাবমেরিন-এর পেরিস্কোপ ও মাথা উঁচু করে। একটু পরে জাপানি সাবমেরিন ভেসে ওঠে জলের ওপর। এই সময় ভেলা ভাসানো হয়। ভেলায় চেপে আসেন নেতাজী ও আবিদ হাসান।

দুর্গম অভিযানের বড় পর্যায়ের শেষ হয়। এরপর একমাস কেটেছিল জাপানি সাবমেরিন-এ। তারপর তিন মাসের সুদীর্ঘ পথ পেরিয়ে সাবমেরিনে চেপে আসার পরে সুমাত্রার সবংয়ে নেতাজি নেমেছিলেন। পায়ের তলায় শক্ত মাটি খুঁজে পেয়েছিলেন। সেই মাটি তাঁকে জীবনের সঙ্গে পরিচয় করিয়েছিল, যে জীবনের স্বপ্ন ছিল স্বাধীনতা। উজ্জ্বল, দীপ্তিময় আশাব্যাঞ্জক স্বাধীনতার আলো দেখাতে পেরেছিলেন তিনি।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...