দুঃখহারী অত্রীশ্বর লিঙ্গের আবির্ভাবের কাহিনী

শিব পুরাণের 'জ্ঞান সংহিতা'র ঊনবিংশতি অধ্যায়ে অত্রীশ্বর লিঙ্গের মাহাত্ম্য কথা রয়েছে। এই অত্রীশ্বর লিঙ্গের মাহাত্ম্য কথা শুধুই দেবাদিদেব মহাদেবের মাহাত্ম্য কথা নয়,  এ এক নারীরও মাহাত্ম্য কথা। এক সতী সাধ্বীর মাহাত্ম্য কথা‌ যার তপস্যায় তুষ্ট হয়ে দেবাদিদেব মহাদেব এবং দেবী গঙ্গা ৫৪ বছর সেই সাধ্বীর আশ্রমে অবস্থান করেছিলেন! অত্রীশ্বর লিঙ্গ সাক্ষাৎ সদাশিব, তিনি অনাবৃষ্টির সময় অত্রি ঋষি ও তার সতী-সাধ্বী পত্নী অনসূয়ার তপস্যায় তুষ্ট হয়ে লোক হিতের সেখানে অবস্থান করতে থাকেন। কিন্তু কী এমন তপস্যা করেছিলেন ঋষি ও ঋষি পত্নী! সূত মুনিদের কাছে সেই কাহিনীই বলতে শুরু করেন।

সূত মুনিদের কাছে বললেন,  দক্ষিণ দিকে কামদ নামে একটি বন রয়েছে, যেটি তপস্যার জন্য অত্যন্ত উত্তম একটি স্থান। সেখানে ব্রহ্মার মানসপুত্র অত্রি ঋষি স্ত্রী অনসূয়া সহ তপস্যা করেন। এই বনে একশ বছর ধরে অনাবৃষ্টি হয়েছিল। দীর্ঘ সময় বৃষ্টি না হওয়ার কারণে সেখানকার মানুষরা অত্যন্ত কষ্ট পেতে থাকে। জল, গাছ সব শুকিয়ে যেতে শুরু করে। এমনকি প্রতিদিনকার প্রাত্যহিক কর্ম করার জন্য কোথাও জল পাওয়া যেত না। দীর্ঘদিন অনাবৃষ্টির কারণে দশ দিক থেকে শুষ্ক বায়ু প্রবল বেগে বইতে শুরু করে। গাছগুলিতে পাতা না থাকার কারণে কোথাও কোনও রকম ছায়া পাওয়া যেত না। এই সমস্ত জিনিস দেখে অত্রি ঋষি অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে পড়লেন। ঋষির যোগ্য পত্নী অনসূয়াও বললেন," আমি আর এই সব সহ্য করতে পারছি না।" এই কথা শুনে অত্রি ঋষি ধ্যানস্থ হলেন। তিনবার প্রাণায়াম করে তিনি তার আসনে বসে ধ্যান করতে করতে সমাধিস্থ হলেন। ঋষিকে সমাধি মগ্ন অবস্থায় দেখে শিষ্যরা তখন আশ্রম ত্যাগ করে চলে গেলেন।

শিষ্যরা আশ্রম ছেড়ে চলে গেলে অনসূয়া একাই পড়ে থাকলেন আশ্রমে। তিনি স্বামীর সেবা করতে শুরু করলেন। অনসূয়া একটি মাটির শিব মূর্তি তৈরি করে যথাবিধি মন্ত্র দ্বারা মানস উপচারে পুজো করতে লাগলেন। এরপর তিনি বদ্ধাঞ্জলি হয়ে তার স্বামীকে ও দেবাদিদেবকে প্রদক্ষিণ করতে শুরু করলেন।

অনসূয়ার রূপ-লাবণ্য দেখে দৈত্যদানব প্রত্যেকেই মুগ্ধ হয়ে উঠলেন। কিন্তু সতী নারীর তেজের কাছে তারা যেতে পারলেন না! মানুষ যেমন অগ্নি থেকে দূরে থাকে ঠিক তেমনভাবেই তারাও অনুসূয়ার থেকে দূরে অবস্থান করতে থাকলেন। এইভাবে দিন দিন অনুসূয়ার তপস্যা ক্রমশ বেড়ে যেতে শুরু করল, তিনি একই সাথে দেবাদিদেবের তপস্যাও করতে থাকলেন এবং স্বামীর পরিচর্যাও। ধ্যানমগ্ন অত্রি ঋষি তার স্ত্রীর তপস্যার বিষয়ে কিছুই জানতে পারলেন না। এইভাবে বহু সময় অতিক্রম হয়ে গেল। স্বামী-স্ত্রী দুজনকেই তপস্যা করতে দেখে দেবগন ঋষিগণ ও গঙ্গা দেবী সকলে অবাক হয়ে উঠলেন। তারা পরস্পর বলাবলি করতে শুরু করলেন যে, উভয়ের মধ্যে কার তপস্যার ক্লেশ ও ফল অধিক?

বিস্তর আলোচনা করার পরে তারা অনসূয়ার তপস্যাকেই শ্রেষ্ঠ বলে গণ্য করলেন। তারা বলতে শুরু করলেন যে, পূর্বে অনেক ঋষিরা তপস্যা করেছেন, কিন্তু কেউই অনসূয়ার মতো তপস্যা করতে পারেননি। এই ঋষি ও ঋষি পত্নী উভয়ই ধন্য- এই বলে তারা যখন সেখান থেকে প্রস্থান করলেন‌ তখন সেখানে গঙ্গা দেবী ও মহাদেব রয়ে গেলেন। গঙ্গা দেবী সতী অনুসূয়াকে বর দিতে চাইছিলেন, তাই তিনি সেখানেই অবস্থান করলেন। দেবাদিদেব মহাদেবও সেখানেই রয়ে গেলেন তাদের কৃপা করবার অভিপ্রায়ে। এইভাবে বহুবছর অতীত হল, ৫৪ বছর চলে গেল তবু জল হলো না সেখানে। যতক্ষণ ঋষি অত্রি ধ্যানে মগ্ন হয়ে থাকতেন, ততক্ষণ আহার গ্রহণ করতেন না অনসূয়া। এক সময় ঋষি অত্রি জাগ্রত হয়ে তার স্ত্রীর কাছ থেকে জল চাইলেন তখন অনসূয়া হাতে কমন্ডলু নিয়ে জলের সন্ধানে বেরিয়ে পড়লেন। কিন্তু কোথায় জল পাবেন চারিদিক তো অনাবৃষ্টির ফলে শুষ্ক! ঋষি পত্নীকে জলের সন্ধানে বের হতে দেখে গঙ্গা দেবী তার পিছন পিছন গেলেন।

গঙ্গা দেবী অনুসূয়াকে বললেন,"হে দেবী আমি প্রসন্ন হয়েছি তোমার কোন আজ্ঞা পালন করব?"

গঙ্গা দেবী তখন বললেন তোমার স্বামীরও শিবের প্রতি সেবা দেখে ও তোমাকে ধর্মশীলা দেখে আমি আমি অবাক হয়েছি। হে শুচিস্মিতা আমি গঙ্গা। তোমার তপস্যা দেখে আসছি। তোমার যা ইচ্ছা বর প্রার্থনা করো।

সতী অনসূয়া তখন দেবী কে প্রণাম করে বললেন যদি আমার প্রতি প্রসন্ন হয়ে থাকেন তবে জল দান করুন। দেবী গঙ্গা তখন তাকে বললেন তুমি একটা গর্ত খনন করো। সতী অনসূয়া তখনই গর্ত খনন করলে দেবী গঙ্গা তার মধ্যে প্রবেশ করে জলময় হয়ে উঠলেন। তখন অনসূয়া অবাক হয়ে বললেন, হে দেবী যদি আমার প্রতি আপনার কৃপা হয়ে থাকে তবে যে পর্যন্ত আমার স্বামী না আসেন সেই পর্যন্ত আপনি এখানে থাকুন।

গঙ্গা দেবী বললেন, হে দেবী আমি সত্য বলছি শোনো আমি এখানে থাকতে পারি যদি তোমার তপস্যার এক মাসের ফল আমাকে দাও।

সতী অনুসূয়া তা দিতে স্বীকৃত হলেন তারপর সেই মতো দুর্লভ জল কলসি ভরে স্বামীকে এনে দিয়ে তার সামনে দাঁড়ালেন সেই জলে আচমন করে তৃপ্তি লাভ করলেন ঋষি অত্রি। এরপর তিনি আশ্চর্য হয়ে ভাবতে লাগলেন চারিদিক এখনো রুক্ষ, গাছপালা এখনো শুষ্ক তাহলে এই জল কোত্থেকে এল? এই ভেবে তিনি তার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন প্রিয়ে বর্ষন তো হয়নি, তবে এ জল কোথায় পেলে?

অনসূয়া তখন ভাবলেন, যদি আমি সত্য কথা বলি তাহলে আমার তপস্যার উন্নতি ব্যাহত হয় আর যদি মিথ্যা কথা বলি তাহলে আমার ব্রতভঙ্গ হয় অতএব যাতে উভয় রক্ষা হয় তাই করতে হবে। পত্নীকে এইরকম ভাবতে দেখে ঋষি বারবার জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন। অনসূয়া তখন বললেন হে স্বামী সত্য বলব শুনুন আমারও আপনার সেবায় তুষ্ট হয়ে গঙ্গা এখানে এসেছেন। এই নির্মল জল তারই। ঋষি অত্রি এইকথা শুনে বিস্মিত হলেন এবং বললেন, হে সাধ্বী তুমি সত্য বলছ না মিথ্যা বলছ! আমি বুঝতে পারছি না। কারণ এই জল অত্যন্ত দুর্লভ! যোগীদের যা সাধ্য নয়, দেবতারা যা পারেন না, আজ তা কীরূপে সম্ভব হল? এজন্য আমার আশ্চর্য বোধ হচ্ছে যদি তুমি তা দেখাতে পারো তাহলে বিশ্বাস করব।

অনসূয়া তখন বললেন যদি আপনার ইচ্ছা হয়ে থাকে তাহলে আসুন। এরপর অনসূয়া স্বামীকে নিয়ে সেখানে গেলেন যেখানে দেবী গঙ্গা অবস্থান করছিলেন তখন সেই জলপূর্ণ গর্ত দেখে পত্নীকে ধন্যবাদ দিলেন ঋষি। তারপর তিনি স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন তোমার তপস্যায় বা কী আমার তপস্যায় বা কী?

এরপর ঋষি পবিত্র গঙ্গার জলে আচমন স্নান করে বার বার স্তব করতে লাগলেন। অনসূয়াও সেই জলে স্নান করলেন। তারপর দুজনে উভয়ের নিত্য কার্য সম্পন্ন করলেন। এরপর দেবী গঙ্গা বললেন, আমি এখন চললাম। দেবী গঙ্গা এই কথা বললে অনসূয়া বললেন, হে দেবী উচিত-অনুচিত যাই হোক না কেন কোন কার্য স্বীকার করে তা কখনই মহৎ ব্যক্তিরা পরিত্যাগ করেন না যদি আমার প্রতি প্রসন্ন হয়ে থাকেন তবে একটি বিষয় আপনাকেও স্বীকার করতে হবে, “হে নদী শ্রেষ্ঠা আমাকে দয়া করতে হবে এই বলে তিনি প্রণাম করে দেবীর স্তব করতে লাগলেন। অত্রি ঋষিও স্তব করে বললেন হে দেবী আমাকে কৃপা করুন...”

এরপর দুজনেই গঙ্গাকে বললেন, হে দেবী আপনি এই তপোবনে অবস্থান করুন।

তাদের কথা শুনে দেবী গঙ্গা অনসূয়াকে বললেন যদি এক বছরের সাধনা ও স্বামী-সেবার ফল আমাকে দাও তাহলে আমি তপোবন এ অবস্থান করতে পারি। পতিব্রতা দর্শনে আমার যে তুষ্টি হয় বারংবার স্নান, দান ও যোগের দ্বারা সে তুষ্টি হয় না‌। পতিব্রতা দর্শনে আমারও পাপ নাশ‌ হয় যদি তুমি এক বছরের তপস্যার ফল দান করো এবং লোকদের হিতের জন্য প্রার্থনা করো তাহলে আমি এই স্থানে অবস্থান করবো।

অনসূয়া তখন পরের হিত কামনার জন্য নিজের একবছরের পুণ্যফল দেবী গঙ্গাকে দান করলেন গঙ্গাদেবী অনসূয়ার একবছরের পূণ্য ফল পেয়ে অন্য কিছু বিচার না করে তপোবনে অবস্থান করাকেই ঠিক বলে মনে করলেন। এরপর ভগবান-শিব ঋষি ও ঋষি পত্নীর সামনে আবির্ভূত হয়ে বললেন," হে অনুসূয়া তুমি আমার নিকট প্রিয় হয়েছ। তুমি বর প্রার্থনা করো"

অনুসূয়া পঞ্চানন শিবকে দেখে অবাক হয়ে বললেন, হে দেবেশ আপনি ও গঙ্গাদেবী যদি প্রসন্ন হয়ে থাকেন তবে লোক সুখের জন্য এই বনে বাস করুন এবং সকলের  সুখ বিধান করুন।গঙ্গা ও মহেশ্বর দুজনেই স্বামী স্ত্রীর তপস্যায় তুষ্ট হয়েছিলেন তাই তারা সেখানে থাকার কথা স্থির করলেন দেবাদিদেব মহাদেব সেখানে দুঃখহারী অত্রীশ্বর নামে খ্যাত হলেন এবং সেখানে পার্বতী ও গঙ্গা সহ অবস্থান করতে শুরু করলেন।

অনসূয়ার খনন করা গর্ত সেই থেকে অক্ষয় হয়ে রইল। স্বর্গের ঋষিরা ও তীর্থবাসীরা পরিমিত অক্ষয় জলপূর্ণ সেই গর্তের নিকটে এসে বাস করতে থাকলেন। সেখানে যব, ধান প্রভৃতি ফসল উৎপন্ন হতে থাকল। দেবতারা ও জল দান করতে থাকলেন ফলে জগতের অনাবৃষ্টি দূর হল।

শিবপুরাণে এই অধ্যায়ের মাহাত্ম্যকথা হিসেবে বর্ণিত রয়েছে যে এই অধ্যায়ে ভক্তিযুক্ত মনে পাঠ করলে মানুষের অশেষ পূণ্য ফল লাভ হয়। পতিত পাবনী দেবী গঙ্গা যাকে দর্শন করে নিজের পাপ নাশ হল বলে মনে করেন, তিনি যে সতীসাধ্বী কে দেখে তুষ্ট হন এবং তার থেকে তপস্যার ফল চান, সতী শ্রেষ্ঠা সেই দেবী অনসূয়ার কথা শুনলে যে কত পূর্ণ ফল লাভ হয় তা বলে শেষ করার নয়!

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...