দোর্দন্ডপ্রতাপ ম্যাজিস্ট্রেট কেদারনাথ দত্ত কীভাবে হয়ে উঠলেন মহাপ্রভুর জন্মস্থানের আবিষ্কর্তা সচ্চিদানন্দ ভক্তিবিনোদ ঠাকুর?

১৮৩৮ সালে নদীয়া জেলার বীরনগর গ্রামে জন্ম হয় কেদারনাথ দত্তের। এই কেদারনাথ দত্ত ছিলেন উড়িষ্যা জেলার দোর্দন্ড প্রতাপ ম্যাজিস্ট্রেট-কিন্তু এই পরিচয়ই তাঁর আসল পরিচয় নয়! ম্যাজিস্ট্রেট কেদারনাথ দত্তের আরও একটি পরিচয় আছে ভক্ত সমাজে,বৈষ্ণব সমাজে আর সেই পরিচয়টাই তাঁর আসল পরিচয়।

হ্যাঁ, উড়িষ্যার দুর্দান্ত প্রতাপশালী এই শাসক‌ই পরবর্তীতে বৈষ্ণব শিরোমণি সচ্চিদানন্দ ভক্তিবিনোদ ঠাকুর নামে পরিচিত হন, আর কে না জানে সচ্চিদানন্দ ভক্তিবিনোদ ঠাকুরের জন্মস্থান‌ই পরবর্তীকালে গৌড়ীয় বৈষ্ণব মঠ নামে পরিচিত হয়! কিন্তু যার জন্মস্থানে আজকের গৌড়ীয় বৈষ্ণব মঠ সেই বৈষ্ণব শিরোমনি সাধবপ্রবরের জীবনকাল, ছাত্রাবস্থা, তাঁর কর্ম সম্পর্কে অনেকেই জানেন না,তাই আজকে আমার এই প্রতিবেদন।

ছোটো থেকেই কেদারনাথ ছিলেন ঈশ্বরের প্রতি গভীরভাবে অনুরাগী, ঈশ্বরকে জানবার গভীর আগ্রহ ছিল তাঁর মধ্যে, একই সঙ্গে কৈশোর বয়স থেকেই তাঁর মধ্যে ছিল প্রবল ভক্তি রস। সেই কারণে ছাত্র অবস্থায় পন্ডিত  ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে ঈশ্বর নিয়ে তর্ক পর্যন্ত জুড়ে বসেছিলেন কেদারনাথ!

বিদ্যাসাগর একবার ছাত্রদের মাঝখানে  বলে বসেন যে, "ঈশ্বরকে  আমরা কেউ যখন দেখিনি, তখন তাকে নিয়ে আলোচনা না করাই ভালো।"- জ্ঞানের সাগরের  এই কথায় অন্য কোন ছাত্র সেদিন বিতর্কে না জড়ালেও ভক্তির সাগর কেদারনাথ সঙ্গে সঙ্গে সেই কথার প্রতিবাদ করে বলেন," পন্ডিতমশাই ঈশ্বরকে না দেখে আপনি বোধোদয়ে ঈশ্বরকে নিরাকার চৈতন্য স্বরূপ বলে লিখেছেন কেন? ঈশ্বরকে  না দেখেই তার সম্পর্কে মতামত প্রকাশ করা কি ভালো হয়েছে?"-কিশোর বয়সে পন্ডিত মশাই বিদ্যাসাগরের ভুল ধরিয়ে তারই মুখের ওপর দৃঢ়ভাবে এই কথা বলা কেদারনাথ ঈশ্বরের প্রতি, ধর্মের প্রতি গভীরভাবে অনুরক্ত হলেও ধর্মের নামে প্রতারণা , ভন্ডামি তিনি মোটেই সহ্য করতে পারতেন না। ভন্ড লোক সাধুর বেশে ঈশ্বরের নাম করে ধর্মভীরুদের ঠকাবে, তা তিনি মোটেই মানতে পারতেন না, সদা সত্যের পূজারী কেদারনাথ যদি দেখতেন, কোনও ভন্ড সাধুকে সাধারণ মানুষ ঈশ্বরের অবতার বলে  পুজো করছেন, তিনি তখনই তার উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতেন, কারণ তাঁর মধ্যে ধর্ম ছিল, ধর্ম নিয়ে ভীরুতা ছিল না। 

একবারের ঘটনা বলি, ওড়িশা জেলার ম্যাজিস্ট্রেট থাকাকালীন কেদারনাথ যখন জানতে পারেন, পুরীতে বিষ্ণুকৃষ্ণ নামে এক সাধুর আবির্ভাব হয়েছে এবং তিনি নিজেই নিজেকে ভগবানের অবতার বলে প্রচার করছেন, প্রচুর লোক সেখানে এসে সাধুকে ভগবানের অবতার রূপে জেনে তাকে সন্তুষ্ট করতে অর্থ , সোনা দানা দান করছে আর সাধুও সেগুলো গ্রহণ করছেন, তখন তিনি কাল বিলম্ব না করে সেই সাধুর আশ্রমে পৌঁছে যান এবং সাধুর কথাবার্তা ও আচরণ দেখে বুঝতে পারেন এই সাধু আসল না, ভন্ড! রাশভারী কেদারনাথ তখন এক মুহূর্ত না ভেবে নিজের কর্তব্য ঠিক করে নেন ও সেই সাধুকে গ্রেপ্তার করে তার শাস্তি বিধান করেন আর এই মানুষটাই পরবর্তীকালে হয়ে ওঠেন ভক্তিবিনোদ ঠাকুর।

কেদারনাথ দত্ত পরবর্তীকালে পুরীর রাজার অধীনে জগন্নাথ মন্দির রক্ষণাবেক্ষণ করার ভার পান, সেই সময় শ্রীচৈতন্যদেব সম্পর্কিত বহু প্রাচীন গ্রন্থ এবং মহাপ্রভুর পার্ষদ ভক্তগণের গ্রন্থ আলোচনা করার সুযোগ হয় তার, এই সময় থেকেই তার জীবন আমূল বদলে যেতে শুরু করে, শৈশব ও কৈশোরে তার মধ্যে বীজরূপে থাকা ভক্তি রস চৈতন্য মহাপ্রভুর গ্রন্থ আলোচনার সুবাদে যেন ডানা মেলে, মহাপ্রভু চৈতন্য দেবের জন্মস্থান কোথায় ছিল তা আবিষ্কার করবার জন্য প্রবল আকাঙ্ক্ষা ও উৎসাহের‌ জন্ম হয় মনের মধ্যে! এমনকি এই জন্মস্থানের হদিশ পেতে তিনি তীর্থে-তীর্থে পর্যন্ত ভ্রমণ করতে শুরু করেন।

এরপর পুরী থেকে কেদারনাথের  কৃষ্ণনগরে বদলি হল, কিন্তু সেই চাকরি ভাল লাগল না, ভক্তি পথ যাকে টানছে, অন্য পথ তার ভাল লাগবে কেন? তাই  চাকরি ছেড়ে তিনি বৈষ্ণব ক্ষেত্র থেকে শিবক্ষেত্রে    ঘুরতে থাকেন। এরপর তিনি দেবাদিদেব মহাদেবের স্বপ্নাদেশ পান, স্বপ্নাদেশে দেবাদিদেব তাঁকে বলেন, নবদ্বীপের কথা। প্রভুর স্বপ্নাদেশ পেয়ে আর কাল বিলম্ব না করে একটি বালককে সঙ্গে নিয়ে তিনি শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুর জন্মস্থান অনুসন্ধান করতে থাকেন নবদ্বীপে। রোদ,বৃষ্টি,পশুর ও সাপের উপদ্রবকে অগ্রাহ্য করে দিনের পর দিন তিনি জনশূন্য বনে প্রান্তরে ঘুরতে থাকেন চৈতন্যদেবের জন্মভিটের খোঁজে। অবশেষে ভগবানের কৃপা হয়, একদিন রাত্রিবেলায় গঙ্গার উত্তর দিকে তিনি দেখতে পান এক আলোকময় অট্টালিকা আর দেখতে পান একটি তালগাছ! 

সাধক কেদারনাথ তখন বুঝতে পারেন ঈশ্বর তাকে সংকেত দিচ্ছেন, এটিই চৈতন্য মহাপ্রভুর জন্মস্থান। এই জন্মস্থান সম্পর্কে পরবর্তীকালে ভক্তি রত্নাকর গ্রন্থে নরহরি চক্রবর্তী লিখেছিলেন, "নবদ্বীপ মধ্যে মায়াপুর নামে স্থান। যথা জন্মিলেন গৌরচন্দ্র ভগবান।। যৈছে বৃন্দাবনে যোগ-পীঠ সুমধুর। তৈছে নবদ্বীপে যোগপীঠ মায়াপুর।।" মহাপ্রভু চৈতন্যদেবের জন্মস্থান আবিষ্কার করবার পর সচ্চিদানন্দ ভক্তিবিনোদ ঠাকুরের আর আনন্দের সীমা থাকে না, তিনি নিজেকে ধন্য মনে করেন।

এই মানুষটিই পরবর্তীতে বর্ণভেদ অস্বীকার করে চৈতন্য মহাপ্রভুর ভাবধারার অনুসারী হয়ে ব্রাহ্মণ থেকে চন্ডাল সবার মধ্যে কৃষ্ণপ্রেম বিলিয়ে গিয়েছেন। ভক্ত জনকে তিনি বলেছিলেন," চন্ডাল চন্ডাল নহে যদি কৃষ্ণ বলে", আবার কখনও বলেছেন," হরি ভক্তি পরায়ণ চন্ডাল ও শ্রেষ্ঠব্রাহ্মণের সমান পূজা পাবার যোগ্য।" বৈষ্ণব ভক্ত ছাড়াও তিনি জ্ঞানী ও কর্মীরূপে ছিলেন আদর্শ, রাজকার্যে বহাল থাকার সময় তিনি শতাধিক মৌলিক গ্রন্থ রচনা করেন, বাংলা ছাড়াও সংস্কৃত ইংরেজি ভাষাতেও তিনি অনেকগুলি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন।

উল্লেখ্য, বীরনগর গ্রামের মন্দির সংলগ্ন যে সাতমহলা, বাড়িতে জন্মেছিলেন সাধক প্রবর কেদারনাথ দত্ত , পরবর্তীকালে ১৯২৭ সালে সেখানকার  সেই সব মন্দিরের সংস্কার সাধন করেই একটি গৌড়ীয় বৈষ্ণব মঠ প্রতিষ্ঠা করেন কেদারনাথের পুত্র ললিতাপ্রসাদ দত্ত।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...