ছুঁচ-সুতো আর জেদকে হাতিয়ার করে এগিয়েছেন এই পদ্মশ্রী পুরস্কারপ্রাপ্ত নকশী-কাঁথা শিল্পী

এক মনে একখানা কাঁথা বুনে চলেছেন। দৃষ্টিশক্তি যে খুব সবল তা নয়, দীর্ঘদিন সেলাইয়ের কাজ করে করে দুর্বল হয়েছে দৃষ্টিশক্তি। সেলাই-এর মাধ্যমে একদিকে শিল্প সৃষ্টি করেছেন, অন্যদিকে পথ দেখিয়েছেন অন্য অনেক মেয়েদের। প্রীতিকণা গোস্বামী। দক্ষিণ-চব্বিশ পরগনার বাসিন্দা প্রীতিকণা গোস্বামী পদ্মশ্রী পুরস্কার প্রাপ্ত। নকশী কাঁথা সেলাই করে তিনি একদিকে নিজের স্বপ্ন গড়েছেন, অন্যদিকে অন্য অনেক মেয়েদের জীবনপথে এগিয়ে চলতে সাহায্য করেছেন।

Pri-1

দক্ষিণ চব্বিশ পরগণায় বাড়ি প্রীতিকণার। গ্রামের সাদামাটা জীবন ছিল তাঁর। অভাব-অনটনের মাঝেই দিন কেটে যেত। পড়াশোনায় আগ্রহ থাকলেও খুব বিশেষ কিছু করার পরিসর ছিল না। তবে ঝড়টা নেমে আসে বাবার অকাল মৃত্যুর পর। ১৯৭৩ সাল তখন। প্রীতিকণা সদ্য ম্যাট্রিক পাস করেছেন। এই সময় মারা যান বাবা। সংসারের হাল ধরার চিন্তায় আর পড়াশোনা সেভাবে হয়নি।

এমন সময় একটা বন্ধুর বাড়িতে তিনি যান। কাজের খোঁজে। বন্ধুটি তখন একটি শাড়িতে সেলাইয়ের কাজ করছিলেন। বাইরে একটি বিশেষ কাজে প্রীতিকণার বন্ধুকে সেলাইয়ের কাজটি অর্ধেক ফেলে রেখেই বেরিয়ে যেতে হয়। বসে না থেকে প্রীতিকণা তখন কিছুটা সেলাই করে দিয়েছিলেন। বন্ধু ফেরার পর সংকোচ, অস্বস্তির কারণে নিজের হাতে করা কাজটার বিষয়ে কিছু জানাননি প্রীতিকণা। তাঁর সেই বন্ধুটি বুঝেছিলেন, এমন অসাধারণ আশ্চর্য হাতের কাজ তাঁর নিজের নয়। এই কাজ প্রীতিকণার।

Pri-2

প্রীতিকণার সেই বান্ধবী তাকে প্রস্তাব দেন এমন অপূর্ব হাতের কাজ যেন সারা বাংলার মানুষের কাছে পৌঁছয়। এই বান্ধবী একটি দোকানের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেন প্রীতিকণাকে। কলকাতার ওই দোকানটিতে কাঁথাস্টিচ-এর কাজ করা শাড়ি বিক্রি হত। প্রীতিকণা তাদের সঙ্গে কথা বলেন। বাড়িতে শাড়ি এনে কাজ করতে গেলে ৫০ টাকা জমা রাখতে হতো। প্রীতিকণার কাছে সেই সময় ছিল মাত্র ৩০ টাকা। তবে সেলাইয়ের কাজে প্রীতিকণার আগ্রহ দেখে সেই দোকানের মালকিন প্রস্তাব দেন দোকানে বসে কিছু একটা সেলাই করে দেখাতে। সেই সময় তাঁর হাতের কাজ দেখে অবাক হন দোকানের মালকিন। এমন চমৎকার হাতের কাজ তিনি আগে কখনো দেখেননি। আর একটা নতুন যাত্রাপথ শুরু হয় তখন থেকেই। সেই পথে কখনো থেমে থাকেনি প্রীতিকণা।

Pri-4

জীবন এগোয়। বিয়ে হয় সন্তান আসে। প্রীতিকণা তবে সেলাইয়ের কাজ বন্ধ করেননি। ১৯৯০ সালে আবার একটা মোড় বদল হয় প্রীতিকণার জীবনে। ক্রাফট কাউন্সিল অফ ওয়েস্ট বেঙ্গল এর তৎকালীন চেয়ারপার্সন প্রীতিকণাকে একটি ওয়ার্কশপ খোলার পরামর্শ দেন। দক্ষিণ ২৪ পরগণার প্রত্যন্ত গ্রামের মেয়েরা তার কাছে কাঁথার কাজ শিখে স্বনির্ভর হতে শুরু করেন। ২০০১ সালে সূচিশিল্পের কাজের জন্য জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন তিনি। তাঁর নিজের মেয়েকেও কাজের অংশীদার করেন প্রীতিকণা। তাঁর কাজকে আন্তর্জাতিক স্তরে পৌঁছে দিয়েছেন তার মেয়ে মহুয়া লাহিড়ী। রাষ্ট্রপতির থেকে পদ্মশ্রী পুরস্কার পেয়েছেন প্রীতিকণা। বর্তমানে তিনি নিজের লড়াইয়ের সঙ্গে এমন অনেক লড়াকু মেয়ের লড়াইকে মিশিয়ে দিয়েছেন। প্রীতিকণা গোস্বামীর কাজের হাত ধরে স্বনির্ভর হয়ে জীবনের পথে এগিয়ে চলেছেন আরো অনেক নারী। এমন ভাবেই তিনি আলো দেখাচ্ছেন এমন অনেক ছোট প্রদীপ শিখাকে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...