কালী কথা: গড়িয়ার বাসনা কালী মন্দির

দেবী কালী মনোস্কামনা পূরণের দেবী, দেবীর কাছে প্রার্থনা করলেই তা পূরণ হয়। দক্ষিণ কলকাতায় গড়িয়ার নারকেল বাগান এলাকায় কামডহরি পাড়ায় রয়েছে শ্রীশ্রী বাসনা কালীবাড়ি। মন্দিরটি নতুন রূপে সম্প্রতি নির্মিত হয়েছে। এই মন্দিরে প্রায় ১৮৯ বছর ধরে পূজিতা হচ্ছেন বাসনা কালীমাতা। জনশ্রুতি অনুযায়ী, দেবী নাকি স্বপ্নাদেশে বলেছিলেন এলাকাবাসীদের মনের বাসনা পূর্ণ করার জন্যই তিনি আবির্ভূতা হবেন, তাই মায়ের নাম হয়েছে বাসনা কালী। 

বহু কাল আগের ঘটনা। সে সময় কালীঘাট ছুঁয়ে গড়িয়ার কামডহরি দিয়ে আদিগঙ্গা বয়ে যেত। কামডহরি ছিল জঙ্গলে ঘেরা একটি এলাকা। সোনারপুর, জয়নগর হয়ে গঙ্গা বিদ্যাধরীতে গিয়ে মিশে যেত। গড়িয়া বাসনা কালী বাড়ির সামনে এখন সেই গঙ্গার পুকুরে পরিণত হয়েছে। তা চাঁদনী ঘাট নামে পরিচিত। শোনা যায়, বাণিজ্যে বেরিয়ে গঙ্গার এই ঘাটেই নাকি নৌকা নোঙর করেছিলেন চাঁদ সওদাগর। স্থানীয় বাসিন্দারা এখনও এটিকে আদি গঙ্গা হিসাবেই মানেন। পুকুর পাড়েই দাঁড়িয়ে রয়েছে বাসনা কালী।

 

basnakali

বোড়াল নিবাসী বসন্তকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এই কালী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কাশী, বেনারস থেকে তৈরি করিয়ে এনেছিলেন দেবীর কষ্টিপাথরের মূর্তি। বসন্তকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বসন্ত ঠাকুর নামে পরিচিত ছিলেন। জনশ্রুতি অনুযায়ী, বসন্ত ঠাকুর দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে দেবীকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আনুমানিক ১৮৩৬ সালে দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন তিনি। স্বপ্নে দেবী বলেছিলেন, তুই এখনই বেনারসে যা। আমি তোর জন্য সেখানে অপেক্ষা করছি। আমাকে এই আদি গঙ্গার তীরে এনে প্রতিষ্ঠা কর। আদেশ শুনে বসন্ত ঠাকুর বেনারস ছুটে যান। কোলে বসিয়ে নিয়ে আসেন কালো কষ্টিপাথরের দেবী কালিকার মূর্তি। বেনারসে যে শিল্পী এই কষ্টিপাথরের কালী তৈরি করেছিলেন, তিনিও একইসঙ্গে স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন। তারপর কালীমূর্তি তৈরি শুরু করেন। বসন্ত ঠাকুরের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ কীভাবে হল সে রহস্য অবশ্য এখনও অস্পষ্ট। স্বপ্নে এসে দেবী কালী বসন্ত ঠাকুরকে বলেছিলেন এলাকাবাসীর কামনা, বাসনা পূর্ণ করার জন্যই তিনি আসবেন। সেই থেকেই নাম বাসনা কালী। ব্রাহ্মণ ছাড়া অন্য কারও কালীকে স্পর্শ করার নিয়ম নেই। আজও বসন্তকুমারের পরিবারের পরবর্তী প্রজন্ম পুজোর দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। 

কষ্টিপাথরের দেবী মূর্তিকে প্রথমে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল হোগলা আর তালপাতা দিয়ে তৈরি মন্দিরে। পরে পূর্ণ সিনেমা হলের মালিক পাকা মন্দির নির্মাণে সাহায্য করেছিলেন। সদ্যই নবরূপে নির্মিত হয়েছে মন্দিরটি। এখানে কালীর সঙ্গে গণেশ, দুর্গা, মনসা, শিব, হনুমান সহ আরও অনেক দেব-দেবীর মূর্তি রয়েছে। তাঁরাও পুজো পান। ২০২৪ সালে নতুন করে নির্মিত হয় মন্দির। ৩০ নভেম্বর সেই নবনির্মিত মন্দিরের দ্বারোদ্ঘাটন করা হয়। নবনির্মিত বাসনা কালী মন্দিরটি নবরত্ন শৈলীতে নির্মিত। উঁচু ভিত্তিবেদির উপরে স্থাপিত মূল মন্দির। প্রতিষ্ঠিত রয়েছে শিবলিঙ্গ এবং নন্দীমূর্তি। বাসনা কালীর কালো কষ্টিপাথরের মূর্তি, দেবী চতুর্ভূজা। তাঁর দুইপাশে এবং সামনে আরও অনেক দেবদেবীর মূর্তি বিরাজমান। এঁদের মধ্যে রয়েছে পাঁচুগোপাল, শিবলিঙ্গ, কৃষ্ণ, বজরংবলী, সোনার কালী, নারায়ণ শিলা, গণেশ, মনসা, মঙ্গলচন্ডী, হরপার্বতী, অষ্টনাগ এবং শনিদেবের মূর্তি। 

এখানে দেবীর নিত্যপুজো হয়। দেবী কালীকে নিরামিষ ভোগ নিবেদন করার রীতি রয়েছে। বসন্ত ঠাকুরের চতুর্থ প্রজন্ম সোমনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বর্তমানে পুরোহিতের দায়িত্ব পালন করছেন। নিত্যপুজো ছাড়াও নববর্ষে হালখাতা, অক্ষয় তৃতীয়া, মঙ্গল চণ্ডী পুজো, বিপত্তারিণী পুজো হয়। ভক্তদের বিশ্বাস, দেবী বাসনা কালী জাগ্রতা। তিনি মনোবাঞ্ছা পূরণের দেবী। দেবীর টানে অসংখ্য ভক্ত পুজো দিতে আসেন এখানে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...