The Story Behind Ranaghat’s Name

রানাঘাটের রানা সর্দার

শিয়ালদহ থেকে মেল লাইনের ট্রেন ধরে সোজা চলে এলেই ঘন্টা দুয়েক পর – রানাঘাট জংশন। নদীয়ার – রানাঘাট বড় চেনা নাম।  জমজমাট মহকুমা শহর। রাস্তা-রাজপথ-আলোবাতিতে উজ্জ্বল – রানাঘাট ইতিহাসের শহর। রানাঘাট কি আদৌ শহর নাকি সমৃদ্ধ মফস্বল এ নিয়ে একাধিক মত থাকতে পারে, কিন্তু রানাঘাট কলকাতার চেয়ে বয়সে পুরনো এই নিয়ে দ্বিমত নেই।

rana

আজকের রানাঘাট দেখে বোঝার উপায় নেই কেমন ছিল প্রাচীন রানাঘাট। সেই  রানাঘাটকে জানতে হলে ঘেঁটে দেখতে হয় বাংলার নীল বিদ্রোহের ইতিহাস। সঙ্গীতের পীঠস্থান রানাঘাট।  

একসময় নীল বিদ্রোহের অন্যতম কেন্দ্র ছিল রানাঘাট। পাশ দিয়ে উদ্দাম বেগে বয়ে যেত চূর্ণি নদী। পুরনো বাড়ি, মহাশ্মশান আর সেকেলে জনপদের রানাঘাটে ঘুরে বেড়ায় অজস্র মিথ আর গল্প।

এই জনপদ রানা সর্দারের জন্মভূমি। রানা সর্দার কে? সেই গল্প জানতে হলে ফিরে যেতে হবে  তিনশো বছর আগের নদের মাটিতে।

নদীয়ার ব্রহ্মডাঙ্গা। সেখানে থাকত এক গৃব ব্রাহ্মণ পরিবার। যজমানি করে তাদের দিন চলে। পরিবারের কর্তা পেশায় পুরোহিত। দিনমানে পুজো-পাঠ আর অবসরে কালীনাম এই নিয়ে ছিল তাঁর জীবন। ব্রাহ্মণের দুই সন্তান। কন্যা মালতী আর পুত্র রানা। বয়েস এগারো। পাঠশালার পাঠে যায় আর বাবার সঙ্গে পুজোয় সাহায্য করে। আর কয়েকটা দিন পরেই তার উপনয়ন। তারপর সেই বাবার মতোই যজমান-পুজো-পাঠে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। যজমানির আয় থেকেই কেটে যাবে জীবন।

ব্রাহ্মণের কন্যাটি ছোট। ন’ বছরে পা দিয়েছে। তাকে নিয়েই ব্রাহ্মণ-ব্রাহ্মণীর যত দুশ্চিন্তা। সাত পেরিয়ে গিয়েছে কবে কিন্তু বিয়ের যোগ এখনো আসেনি। সে সময় গাঁ-ঘরের চোখে ন বছরের কন্যা অবিবাহিত থাকলে এক ঘরে হতে হয় বাপমাকে।  

মেয়ের বিয়ের খরচ জোটাতে নাকাল গরীব ব্রাহ্মণ। তারা কুলীন পরিবার। তাই কুলীন ব্রাহ্মণ পাত্রই চাই। যত দিন যায় তত চোখের ঘুম উড়ে যায় পরিবারের। যজমান ছাড়া তাদের আর কোনও সংস্থান নেই। এক মনে ডেকে চলে কালীমাকে।

একদিন গ্রামের শিরোমণি ডেকে হুমকি দিল ব্রাহ্মণকে। মেয়ের বয়স দশ পেরিয়ে গিয়েছে, ভাদ্র মাসের মধ্যে মেয়ে-পার না করলে সমাজ পতিত করবে তাকে। যজমানও আর মিলবে না, তখন না খেয়ে মরতে হবে যে! 

পেটের দায় বড় দায়, তার কাছে তুচ্ছ হয়ে যায় দারা-পুত্র-পরিবার। শেষে ভিটে-মাটি শেষ সম্বল বিক্রি করে মেয়ের বিয়ে ঠিক হল। কিন্তু পণ চাই বহু। সবটা জোগাড় করে উঠতে ব্রাহ্মণ।

বিয়ের রাতে সে কথা জানতে পারার পর বিয়ে থেকে বর তুলে নিয়ে চলে যায় পাত্রপক্ষ। ভাঙা বিয়ের আসর থেকে ঘরছাড়া হয় মালতীও। পরদিন সকালে ভেসে ওঠে পুকুরের জলে। রাতারাতি বদলে যায় ব্রাহ্মণ পরিবার।

শোক ভুলতে বাড়ি ছাড়ে মালতীর দাদা রানা। তবে ফিরে আসে একদিন। একেবারে অচেনা হয়ে।

গাঁয়ের মানুষ ভুলে গিয়েছিল সে রাতের ঘটনা। মালতীকেও কেউ মনে রাখেনি। কিন্তু রানার মনে স্থায়ী দাগ রেখে গিয়েছিল বোনের মৃত্যু। ঘুরিয়ে দিয়েছিল জীবনের মোড়। গরীব ব্রাহ্মণপুত্র রানা হয়ে উঠেছিল দুর্ধর্ষ ডাকাত রানা সর্দার।

বাঘের মতো হিংস্র ছিল রানা। তার লক্ষ্য ছিল ধনী আর জমিদাররা। কিন্তু আরও এক রূপ ছিল তার। কন্যাদায় গ্রস্থ বাবার বড় ভরসার জায়গা ছিল রানা সর্দার। প্রথার চাপে বৃদ্ধের সঙ্গে দুধের বালিকার বিবাহ, পণের চাপ, বিয়ের নামে অত্যাচার হলে রণে পায়ে নিজের দল নিয়ে চলে আসত ডাকাত সর্দার।

ব্রহ্মডাঙ্গার ভিতরে ছিল তার আস্তানা। কালী মায়ের ভক্ত ছিল। গ্রামে গ্রামে জমিদাররা তটস্থ থাকত তার নামে। আবার কালীর ভক্ত রূপেও অনেকে চিনত তাকে।

পরবর্তী জীবনে রানা সর্দারের পরিনতি কী হয়েছিল তা নিয়েও ধন্দ আছে। একটি মিথ বলে, এক সময় ডাকাতির দল থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিল সে। তারপর নিরুদ্দেশ হয়ে যায়, আর কেউ তার খোঁজ পায়নি। আর একটি মিথ বলে পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হয়েছিল রানার।

রানা সর্দারের ডাকাত দলের পরের ক্যাপ্টেন হয় হাবুল সর্দার। 

সময় পেরিয়েছে তিনশো বছর। বদলে নিয়েছে নদীয়া। কেতাদুরস্ত হয়েছে রানাঘাট। কিন্তু লোক মুখে কথার আদলে আজও বেঁচে আছে রানা সর্দার আর তার ঘুরে দাঁড়ানোর কাহিনি। লোকে বলে তার স্মৃতিতেই ব্রহ্মডাঙ্গা নাম বদলে হয়ে যায় রানাঘাট। ইতিহাসবিদ প্রিঙ্গিলও এমন দাবী করেছেন। তবে দ্বিমত আছেই।   

বেড়াতে যাওয়া যায় রানাঘাট। দেখার মতো আছ অনেক কিছু।

 রানাঘাটের দ্রষ্টব্য স্থানগুলি হল— রানা ডাকাতের প্রতিষ্ঠিত সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দির, পালচৌধুরীদের পূর্বতন ভদ্রাসনের প্রাচীরের মধ্যে একই ভিতের উপর প্রতিষ্টিত জোড়া শিব মন্দির। চূর্ণী নদীর তীরে বড়বাজারে জগন্নাথ-সুভদ্রা-বলরামের মন্দির। জমিদার রতন পালচৌধুরীর বিধবা পত্নী উজ্জ্বলমণি দাসীর প্রচেষ্টায় ৯৫ হাজার টাকা ব্যয়ে নির্মিত নিস্তারিণী মন্দির, রানাঘাট শহরের স্কুল মোড়ে প্রতিষ্টিত চিন্ময়ী ও মৃন্ময়ী মন্দির, ব্রজবল্লভ মন্দির জহুরা কালীবাড়ি এবং ছোটবাজারের রাধাবল্লভ মন্দির।

 

 

 

তথ্য ঋণঃ বাংলার ডাকাতঃ যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত

 বাংলার ডাকাতঃ পাঁচুগোপাল ভট্টাচার্য

     

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...