কোথায় থাকেন শ্রীরামকৃষ্ণদেবের ‘মেজমাসী’, দক্ষিণেশ্বরের মা ভবতারিণীর দুই বোন?

দক্ষিণেশ্বরে ভবতারিণী মায়ের বাস। দূর দূরান্ত থেকে ভক্তরা আসেন মায়ের টানে। সালংকারা বরাভয়দায়িনী মা ভক্তদের কাছে দুঃখহারিণী মা। তাঁর করুণায় জয় করা যায় সব দূঃখ ক্লেশ। তাঁদের অপার ভক্তিরসে প্লাবিত হয় এই কালী ক্ষেত্র।

এই মূর্তিকে মাতৃজ্ঞানে পুজো করতেন শ্রীরামকৃষ্ণদেব। এই ভবতারিণী মূর্তি নির্মাণ করেছিলেন বিখ্যাত শিল্পী নবীন ভাস্কর তাঁর জন্ম ১৮০৬ সালে বর্ধমান জেলার দাঁইহাটায়।  বর্তমানে দাঁইহাটা  পৌরসভা পূর্ব বর্ধমানের অন্তর্গত।

IMG-20231102-WA0018

১৮৫০ সালে নবীন ভাস্করের বাবা শ্রীরামচন্দ্র ভাস্কর কলকাতায় ৩৭৪ আপার চিৎপুর রোডে 'ওরিয়েন্টাল স্টোন ওয়ার্ক' নামে একটি পাথরের মূর্তি নির্মাণের স্টুডিও করেছিলেন।

বর্তমানে এই ঠিকানার কোনও অস্তিত্ব নেই। বর্তমানে এই ঠিকানার কোনও অস্তিত্ব নেই। যদিও রানী রাসমণি তাঁর স্বপ্নের কালী মূর্তি নির্মাণে প্রথম দাঁইহাটায় ভাস্করের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়ে আসেন। কিন্তু রানীকে প্রত্যাখ্যানের পর ভাস্করের নির্মিত একটি ঠাকুর অপ্রত্যাশিতভাবে তারই হাতে ভেঙে যাওয়ায় তিনি রানীর কাছে যান ক্ষমা চাইতে। তাতে রানী খুশি হয়ে স্বপ্নের রূপ ও ঠাকুরের আকার বলে দেন। শুরু হলো নির্মাণ। কিন্তু কিছু সমস্যার সম্মুখীন হন ভাস্কর।

IMG-20231102-WA0019

দক্ষিণেশ্বরের কালীমূর্তি নির্মাণের ২ বছর আগে নবীন ভাস্কর আরও দুইটি মূর্তি নির্মাণ করেছিলেন। কিন্তু প্রথম মূর্তির আকার মন্দিরের গর্ভগৃহের তুলনায় ছোট হয়ে যাওয়ায় তার সেই মন্দিরে প্রতিষ্ঠা হয়নি। স্বাভাবিকভাবেই  ভাস্কর খানিক বিমর্ষ হয়ে পড়েন এবং সেই প্রথম তার নির্মিত মূর্তির প্রতিষ্ঠা প্রত্যাখ্যাত হয়।

পরের মূর্তিটির ক্ষেত্রেও বিষয়টি খানিক একই রকম হয়, তবে এবার আকার এতটাই বড় হয়ে যায় যে তা গর্ভগৃহে প্রবেশ করানো যায়নি।  আবারও এল প্রত্যাখ্যান। এরপর নির্মিত মূর্তিটি দক্ষিণেশ্বরে প্রতিষ্ঠিত ভবতারিণী।

এতো গেল তিন বোনের নির্মাণের কথা। বোন বলার কারণ হল, মূর্তি তিনটি একই কষ্টি পাথর থেকে নির্মিত।  প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে তখন কষ্টি পাথর খুব সুলভ ছিল না। কিন্তু নবীন ভাস্করকে এব্যাপারে পূর্ণাঙ্গ সাহায্য করেন বর্ধমানের মহারাজ। তিনি পশ্চিম জামালপুরের একটি পাহাড় কিনে নেন, সেই পাথর দিয়েই এই তিন মূর্তি হয়।

প্রথম মূর্তিটি শিবচন্দ্র গোহ ১২৫৭ বঙ্গাব্দে অর্থাৎ ১৮৫০ সালে উত্তর কলকাতার হাতিবাগান অঞ্চলে তাঁদের পৈতৃক বাড়ির মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করেন। অর্থাৎ ১১, বৃন্দাবন বসু লেন। এই বিগ্রহের নাম 'নিস্তারিণী'। দ্বিতীয় মূর্তিটি প্রতিষ্ঠিত হয় দে-প্রামাণিক কালী বাড়িতে। তৃতীয় মূর্তিটি হলেন মা  ভবতারিনী। যিনি দক্ষিণেশ্বরে বিরাজ করছেন

সর্বপ্রথম তৈরি হয় জয় মিত্র কৃপাময়ীর মূর্তি। এরপর তৈরি হয় ব্রহ্মময়ী ও মা ভবতারিণীর বিগ্রহ। এক্ষেত্রে বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার সময়কালের ভিত্তিতে বড় বোন-ছোট বোন নির্ধারিত হয়নি, বিগ্রহের উচ্চতার ভিত্তিতে বড় বোন-ছোট বোন ঠিক হয়েছে। তিনটি মাতৃ মূর্তির উচ্চতা অনুযায়ী ভবতারিণীর মূর্তিই সবথেকে বড়। তাই সে বড় বোন। মেজ ও ছোট হলেন মা কৃপাময়ী ও মা ব্রহ্মময়ী। এই তিন দেবী মূর্তির নামকরণও করেন একই মানুষ। তিনি আর কেউ নন, স্বয়ং শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব।

১৮৪৮ সালে বরাহনগরের জমিদার জয়নারায়ণ মিত্র তৈরি করেন কালীমন্দির। মন্দিরে ছিল ১২ টি শিব মন্দির ও একটি বড় কালীমন্দির। শোনা যায়, এই মন্দির দেখেই নাকি রানি রাসমনী দক্ষিণেশ্বরের মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন৷ তার তিন বছর পর ১৮৫৩ সালে মাঘী পূর্ণিমায় তৈরি হয়েছিল ব্রহ্মময়ী কালী মন্দির৷

দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের দু’বছর আগে বরানগরের এই মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়। মায়ের জন্ম দিন মাঘী পূর্ণিমাতে উদযাপিত হয়। কালী পুজোর দিন বিশেষ পুজো হয়, ভোগ হয় তবে অন্ন ভোগ নয়। একই পাথর থেকে নির্মিত হওয়ায় এবং আকারে ছোট হওয়ায় শ্রী রামকৃষ্ণ প্রথম এই মাকে 'মাসি' বলে সম্বোধন করেন, সেই থেকেই ইনি ‘মেজো মাসি’ নাম খ্যাত। আজও তিনি মহাসমারোহে নিত্য পূজিতা হন।

মন্দিরে নিত্য পুজো হয়। এছাড়াও প্রত্যেক মাঘী পূর্ণিমায় প্রতিষ্ঠাতিথিতে বিশেষ পুজো হয়। দীপাবলীতে অর্থাৎ কার্তিক অমাবস্যায় বিশেষ পুজোর আয়োজন করা হয়। মহাধুমধাম করে পুজো হয়। 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...