উত্তর ২৪ পরগণার দক্ষিণেশ্বরে লোকমাতা রাণী রাসমণি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ভবতারিণীর মন্দির। সাধক রামকৃষ্ণের সাধনক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল সে মন্দির। দ্বিতীয় দক্ষিণেশ্বর রয়েছে হুগলিতে। কয়েক বছর হল হুগলি জেলার গুড়াপের বারুল গ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মা ভবতারিণীর মন্দির। বারুলের এই মা ভবতারিণী মন্দিরই ভক্তদের কাছে দ্বিতীয় দক্ষিণেশ্বর মন্দির নামে পরিচিত। মন্দিরের স্থাপত্যশৈলী থেকে রঙ, দেবী কালীর বিগ্রহ সবই দক্ষিণেশ্বরের অনুরূপ। কালীর মূর্তি দেখলে মনে হয় অবিকল যেন মা ভবতারিণীর বিগ্রহের প্রতিরূপ। বারুল কালী মন্দিরের অধিষ্ঠাত্রী দেবীও মা ভবতারিণী নামেই পূজিতা হচ্ছেন।
মন্দিরের আধুনিক রূপ কয়েক বছর হল নির্মিত হলেও, বারুল গ্রাম ভবতারিণীর পুজো হচ্ছে কয়েক শতক ধরে। দীর্ঘ দিন ধরে বারুলের মা ভবতারিণী গোরেনের মা বা ছোট মা নামে পূজিতা হয়ে আসছেন। গ্রামের গোরেন পুকুরে মাটি কাটার সময় অষ্টধাতু নির্মিত ভবতারিণীর মূর্তি পাওয়া গিয়েছিল। তারপর
পুকুরের দক্ষিণ পাড়ে মাটির ঘর ও খড়ের ছাউনির নিচে মায়ের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে শুরু হয় পুজো। আঠারো শতকে কোনও এক বিত্তবান মহিলা এই দেবীর স্বপ্নাদেশ পান। তারপর কলকাতা থেকে হুগলি এসে পাকা দালানের স্থায়ী মাতৃ মন্দির গড়েন। অষ্টধাতুর কালী মায়ের বিগ্রহটি আনুমানিক প্রায় ৭০০ বছর ধরে পূজিতা হচ্ছে।
কালের নিয়মে সেই মন্দির জরাজীর্ণ হয়ে পড়ে। স্থানীয়রা এবং ভক্তরা নিজেদের উদ্যোগে মন্দির সংস্কার ও পুনর্ণিমাণে ব্রতী হন। বারুল গ্রামের জনৈক মতিলাল চক্রবর্তী ছিলেন অন্যতম উদ্যোগক্তা। দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণী মন্দিরের আদলে নতুন মন্দির গড়ার কাজ শুরু হয়। ২০১৫ সালের ১৫ মে মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্ত স্থাপন করা হয়। দীর্ঘ ছয় বছর ধরে কাজ চলে। ২০২১ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি, বাংলা ১১ ফাল্গুণ মা ভবতারিণীর নয়া মন্দিরের দ্বারোদ্ঘাটন করা হয়। মন্দির পরিচালনার দায়িত্ব সামলাচ্ছে একটি ট্রাস্ট। মন্দিরের পাশে আজও রয়েছে গোরেন পুকুর, কয়েকশো বছর আগে সেই পুকুর থেকেই গোরেনের মায়ের অষ্টধাতুর মূর্তি উদ্ধার হয়েছিল।
দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরের আদলেই মন্দিরটি নির্মাণ করা হয়েছে। এটিও নবরত্ন মন্দির। অর্থাৎ মন্দিরটি নয় চূড়াবিশিষ্ট। প্রধান ফটক দিয়ে মন্দির প্রবেশ করলেই রয়েছে সুন্দর, সুবিশাল বিস্তৃত নাটমন্দির।নাটমন্দিরের বাম পাশে রয়েছে রাধাগোবিন্দ মন্দির। অন্য পাশে রয়েছে গ্রহরাজ শনিঠাকুরের মন্দির। নাটমন্দির পেরিয়ে মন্দিরের মূল গর্ভগৃহ। সেখানে পদ্মের উপর সিংহাসনে অধিষ্ঠাত্রী দেবী ভবতারিণী। বারুলের গোরেনের মা আদপে দক্ষিণা কালী। দক্ষিণেশ্বরের মায়ের মতোই তাঁর রূপ। মায়ের বিগ্রহের পায়ের নিচে বিরাজ করেন মহাদেব। দেবাদিদেবের জটার কাছে অষ্টধাতুর ছোট কালী মূর্তি আজও পুজো পান। এটিই সেই প্রাচীন কালী মূর্তি যা গোরেনের মা নামে পূজিত হত। কালীর সিংহাসনে, তাঁর সঙ্গেই অধিষ্ঠান করে মা সারদা, শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, স্বামী বিবেকানন্দ এবং গণেশ ঠাকুরের প্রস্থর বিগ্রহ। গর্ভগৃহের দুই পাশে রয়েছে দুটি শিবমন্দির। একটি শিব মন্দিরে কালো কষ্টিপাথরের বাবা পঞ্চানন শিবলিঙ্গ অধিষ্ঠিত। অপর শিবমন্দিরে অধিষ্ঠিত শ্বেতপাথরের বাবা কল্যাণেশ্বর শিবলিঙ্গ। পাশেই রয়েছে হনুমান মূর্তি। দুটি শিব মন্দিরেই রয়েছে ষাঁড় নন্দীর বিগ্রহ। উভয় শিবলিঙ্গের মাথায় রয়েছে ধাতুর তৈরি নাগরাজ এবং পাশে থাকে ত্রিশূল।
প্রতিদিন দুই বেলা করে মায়ের নিত্যপুজো হয়। মা ভবতারিণীর সঙ্গে সকল দেবদেবীই নিত্যদিন পুজো পান। প্রতি বছর ২৪ ফেব্রুয়ারি মন্দিরের প্রতিষ্ঠা দিবসে বিশেষ পুজো হয়। রথযাত্রা, ঝুলন, জন্মাষ্টমী, দীপান্বিতা কালী পুজো, রাস পূর্ণিমা, শিবরাত্রি, দোল পূর্ণিমা ধুমধাম করে পালিত হয় মন্দিরে।
অমাবস্যা তিথিতে ও শনিবারে বিশেষ পুজো হয়। শনি ও মঙ্গলবারে ভক্তরা ভিড় জমান।