শিব ও অষ্ট মাতৃকার পুরাণকথা

শিবকে বলা হয়, 'কৃত্তিবাস'। কেন বলা হয়? কারণ, 'কৃত্তি' বলতে অভিধান মতে 'পশুর চামড়া', 'বাঘের চামড়া', 'হাতির চামড়া'--এই তিনটি অর্থকেই বোঝায়। সুতরাং, 'কৃত্তি' যাঁর বাস বা পরিধান, তিনিই হলেন 'কৃত্তিবাস'। 

শাস্ত্রকার, শিল্পী কিংবা লোকসাধারণ 'কৃত্তি' কথার ওই তিনটি অর্থের যে-কোন একটিকে গ্রহণ করেছেন নিজস্ব রুচিতে বিভিন্ন সময়ে, তাই শিবের রূপবর্ণনায় ও মূর্তি-নির্মাণে বা পটচিত্রণে আমরা কখনও দেখি শিবের পরিধানে বাঘের ছাল, কখনও দেখি হাতির চামড়া। 

'বরাহ পুরাণ'-অনুসারে শিবের বস্ত্র হাতির চামড়া। কিন্তু, পরবর্তীকালের শাস্ত্র 'তন্ত্রসার'-এ বলা হচ্ছে যে, শিবের বসন বাঘের চামড়া। যাই হোক, 'বরাহ পুরাণ'- এর উপাখ্যান অবলম্বনে আজ আমরা বলব কেমন করে শিবের বসন হয়ে উঠল পশুর চামড়া অর্থাৎ হস্তিচর্ম। গল্পটি শুনুন :

সে-বার অন্ধক নামের এক অসুর মহা মাতব্বর হয়ে উঠল। হয়ে উঠল সেই ব্রহ্মার বরেই। তার নিদারুণ কঠোর তপস্যায় দারুণ তুষ্ট হয়ে ব্রহ্মা বর দিয়ে বসলেন যে, একমাত্র শিব-শঙ্কর ছাড়া আর কেউ অন্ধকাসুরকে বধ করতে পারবে না। তাও আবার তিন-তিনটি শর্তে। যথা--অস্ত্র ছাড়া মৃত্যু হবে না, হত্যার সময় অন্ধকাসুরের দেহ মাটি স্পর্শ করতে পারবে না, রক্ত মাটিতে পড়বে না!

ব্যস, অন্ধকাসুর তাতেই ধরাকে সরাজ্ঞান করল। সমগ্র পাতাল ও মর্তলোকের অধীশ্বর হয়ে দেবতাদের স্বর্গছাড়া করল। তখন স্বর্গের রাজা হয়ে অপ্সরা ও নর্তকীদের নিয়ে তার উল্লাস আর বিলাসের অবধি রইল না। তারপর মনে মনে ফন্দি আঁটতে লাগল পরমশত্রু শিবকে হত্যা করে পার্বতীকে বিয়ে করার।

ওদিকে দেবতারা ঘরছাড়া হয়ে মহা বিপদে পড়লেন। বেঘোরে কোথায় কোথায় আর ঘুরে বেড়াবেন! কাজেই, উদ্ধারের প্রার্থনা নিয়ে হাজির হলেন গিয়ে ব্রহ্মলোকে ব্রহ্মার কাছে। ব্রহ্মা জানেন যে, একমাত্র শঙ্কর ছাড়া আর কেউ এ-বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারবেন না দেবতাদের। ফলে, তিনি তাঁদের নিয়ে সটান হাজির হলেন গিয়ে কৈলাসে।

ভাগ্যি ভালো, শিব তখন ধ্যানে মগ্ন ছিলেন না। বিনা আয়াসেই দেবতারা নিজেদের বিপদের কথা তাঁকে নিবেদন করতে পারলেন। তারপর শিবের গুণগান করে অন্ধকাসুরকে বধ করার জন্য বার বার অনুরোধ করতে লাগলেন।

এমন সময় সেখানে বিশাল সেনা নিয়ে বীভৎস মারমুখো মূর্তিতে ঝড়ের মতো হাজির হল অন্ধকাসুর। এসেই দেবতাদের উদ্দেশ্যে বিচ্ছিরি রকমের তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, এই মহাদেব তোমাদের রক্ষা করবে নাকি! ওকেই কে রক্ষা করে তার ঠিক নেই! এক্ষুনি তোমাদের চোখের সামনেই ওকে মেরে পার্বতীকে রানি করব, দেখতে থাকো!

অন্ধকাসুরের আস্ফালন শুনে মৃদু মৃদু হাসছিলেন মহাদেব। কিন্তু, শেষ কথাটা তাঁকে চরম ক্রুদ্ধ করে তুলল। তিনি যুদ্ধের জন্য উঠে দাঁড়ালেন। অমনি সাপেরা ছুটে এসে তাঁর ভূষণ হল, নন্দী এসে তাঁকে পিঠে ধারণ করল, ত্রিশূল আবির্ভুত হল হাতে। শিবের গণ ও অনুচরেরাও ছুটে এসে তাঁর পিছনে প্রস্তুত হয়ে দাঁড়াল। শিবকে রুদ্ররূপে দেখে দেবতারাও প্রস্তুত হলেন ভীষণ যুদ্ধের জন্য। বেজে উঠল শিঙ্গা-দুন্দুভি-যুদ্ধের বাজনা।

সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকাসুরের নীল নামের এক অনুচর মায়াবলে মিশমিশে এক কালো হাতির রূপ ধারণ করে ফেলল। তারপর শুঁড়ে আছড়ে বধ করার জন্য তিরের মতো ছুটে এল শিবের দিকে। সে যেই শিবের অঙ্গ স্পর্শ করতে যাবে, অমনি শিবের অনুচর বীরভদ্র সিংহের রূপ ধারণ করে ঢাল হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। শুরু হল হাতি ও সিংহের ঘোরতর লড়াই। তারপর একসময় সিংহ হাতিকে পেড়ে ফেলল, ফেঁড়ে ফেলল এবং মেরে ফেলল।

তখন সিংহরূপ ছেড়ে বীরভদ্র হাতির শরীর থেকে পুরো চামড়া টেনে তুলে ফেলল। সেই চামড়া এনে নতজানু হয়ে উপহার দিল শিবকে। শিব তা গ্রহণ করে কটি থেকে আজানু বেঁধে ফেললেন। বসন করলেন।

ওদিকে অনুচরের এমন শোচনীয় মৃত্যু চোখের সামনে দেখে রাগে-অপমানে অধীর হয়ে অন্ধকাসুর সেনা নিয়ে দেবতাদের ওপর তড়িৎগতিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। শুরু হল ভয়াবহ এক যুদ্ধ। যুদ্ধের খবর পেয়ে গরুড়ে চেপে ত্বরিতে এলেন বিষ্ণু। সুদর্শন নিয়ে তিনিও শামিল হলেন।

একে একে সমস্ত দেবতাকে পরাজিত করে অট্টহাসি হাসতে হাসতে শিবের সামনে এসে দাঁড়াল অন্ধকাসুর। প্রচণ্ড ঘৃণায় শিব অমনি ত্রিশূলের এক আঘাতেই তার মাথা কেটে ফেললেন। ফিনকি দিয়ে মাটিতে ঝরে পড়তে লাগল সহস্র ধারায় রক্ত। সেই রক্ত থেকে রক্তবীজের মতো জন্ম নিতে লাগল লক্ষ লক্ষ মায়া -অন্ধকাসুর। সেই সঙ্গে কাটা মাথাটিও জুড়ে গেল অন্ধকাসুরের। সে আবারও অট্টহাস্য করতে করতে উঠে দাঁড়িয়ে নতুন জন্ম নেওয়া মায়া-অন্ধকাসুরদের সঙ্গে মিলে যুদ্ধ করতে লাগল। সে যে কী ভয়ানক যুদ্ধ, ভাষায় বর্ণনা করা যায় না!

ত্রিশূল দিয়ে শিব এবং সুদর্শন দিয়ে বিষ্ণু রক্ত থেকে জন্ম নেওয়া মায়া-অন্ধকাসুরদের একে একে বধ করলেন। তারপর শিব আসল অন্ধকাসুরকে বাগে পেয়ে ত্রিশূলে বিদ্ধ করে আকাশে তুলে ধরলেন। প্রচণ্ড রাগে তিনি প্রলয় নাচন নাচতে লাগলেন। তাঁর মুখ থেকে বেরুতে লাগল লেলিহান আগুনের তীব্র হলকা। ত্রিশূলের বিদ্ধ অংশ থেকে বেরিয়ে আসা অন্ধকাসুরের রক্তধারা সেই অগ্নিশিখায় পুড়ে পুড়ে যেতে লাগল।

রক্তের ধারা যখন প্রবল হল, তখন শিব-বিষ্ণু ও অন্যান্য দেবতাদের ধ্যানে সাহায্যের জন্য উদ্ভুত হলেন অষ্ট মাতৃকাশক্তি। এঁরা হলেন--'ব্রহ্মণী', 'কৌমারী', 'বৈষ্ণবী', 'বারাহী', 'যমী', 'যোগেশ্বরী' এবং 'মাহেন্দ্রী'। এঁরা অন্ধকাসুরের রক্তধারা মাটিতে পড়তে দিলেন না, আপন মায়াশক্তিতে ধারণ করলেন। সমবেত প্রয়াসে একসময় অন্ধকাসুরের রক্তস্রোত শুকিয়ে গেল। আসুরীশক্তি বিনষ্ট হল। শিবের ত্রিশূলে বিদ্ধ হয়েই সে প্রাণত্যাগ করল। 

অন্ধকাসুর মরতেই শিবের ক্রোধ প্রশমিত হল। তিনি নৃত্য থামিয়ে শান্ত হলেন। তখন দেবতাদের মধ্য থেকে এবং সমস্ত চরাচরে শিবের নামে জয়ধ্বনি উঠল। তাঁকে 'কৃত্তিবাস' বলে সম্বোধন করা হল। এই নব-নাম পেয়ে শিব অত্যন্ত খুশি হলেন। যুদ্ধকালে পরিহিত হাতির চামড়াটিকে নিজের শাশ্বত বসন করে তুললেন। হয়ে উঠলেন, 'কৃত্তিবাসী' মহেশ্বর।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...