নবদ্বীপ শহরের বেশ কিছু প্রাচীন দুর্গাপুজো একেবারে অন্যরকম। তেমনি উল্লেখযোগ্য একটি দুর্গাপুজো যোগনাথ টতলা এলাকার ভট্টাচার্য বাড়ির পুজো। এই বনেদি পরিবারের পুজো আজও অন্যরকম কারণ এখানে ঐতিহ্যবাহী দুর্গা প্রতিমার গায়ের রং টকটকে লাল। অন্যান্য মৃন্ময়ী মূর্তির থেকে একেবারেই আলাদা। প্রতিমার বর্ণ অতসীর বদলে টকটকে লাল বা রক্ত বর্ণের হয়।
আরো একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে এই পুজো অন্যরকম। এখানে চণ্ডীপাঠ ছাড়াই পূজিত হন দেবী দুর্গা। আনুমানিক সাড়ে তিনশো বছরের পুজো এটি। ইতিহাসের তথ্য অনুযায়ী ১৬৭০ খ্রিস্টাব্দে অর্থাৎ ষোড়শ শতাব্দীর শেষ দিকে অবিভক্ত বাংলার নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর দেওয়ান রাজাদর্পনারায়ণ রায়ের পৃষ্ঠপোষকতায় বর্তমান বাংলাদেশের ঢাকা জেলার মিতরায় গ্রামে এই পরিবারের আদি বাসস্থান ছিল। সেখানেই মন্দির প্রাঙ্গণে প্রথমেই পুজোর প্রচলন করা হয়। পরিবারের পূর্বসূরী রাঘব ভট্টাচার্য পূজো শুরু করেছিলেন। দেবী দুর্গার গায়ের রং ছিল অতসী। প্রতিবছর নিয়ম করে পুজো হতো। চণ্ডীপাঠ ও হত। কিন্তু প্রায় ১৫ বছর পর ঘটে একটি অলৌকিক ঘটনা।
১৬৮৫ খ্রিস্টাব্দে নবমীর দিন দক্ষিণমুখী অতসী বর্ণের দুর্গা প্রতিমার পূজা-অর্চনা চলাকালীন সেই সময় গৃহকর্তা রাঘবরাম ভট্টাচার্য চণ্ডীপাঠ করছিলেন। যথেষ্ট মন দিয়েই দেবীর পুজো করছিলেন তিনি। তবে মহাষ্টমীর পুণ্য লগ্ন তিথি অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার কারণে তিনি খুব তাড়াতাড়ি চণ্ডীপাঠ করা শুরু করেন। বাবা তাড়াতাড়ি চন্ডীপাঠ করার মাঝে তাঁর সন্তান কিছু ভুল খুঁজে পায়। রাঘবরাম ভট্টাচার্যের তৃতীয় পুত্র রামভদ্র ভট্টাচার্য তখন নিজের গর্ভধারিনী মাকে সে কথা জানায়। কোন এক আশ্চর্যভাবে সেই কথা যেন পৌঁছে যায় দেবী দুর্গার কাছেও। সেই মুহূর্তে চন্ডীপাঠরত রাঘবরাম ভট্টাচার্যের কাছেও সেই কথা পৌঁছয়। অত্যন্ত রেগে যান তিনি। শুনতে পেয়ে নিজের ছেলেকে দুর্গা মূর্তির সামনে বসে চন্ডীপাঠ করার নির্দেশ দেন ক্ষুব্ধ বাবা রাঘবরাম ভট্টাচার্য। লজ্জিত হলেও বাবার নির্দেশ উপেক্ষা করা সম্ভব হয়নি রামভদ্রর। দেবী দুর্গার সামনে বসে তিনি শুরু করেন চন্ডীপাঠ। এমন সময় ঘটে একটি অলৌকিক ঘটনা।
দক্ষিণমুখী দুর্গামূর্তি হঠাৎ দিক পরিবর্তন করে পশ্চিমমুখী হয়ে যায় এবং দিক পরিবর্তন করে রাঘব রামের পুত্র রামভদ্রের সামনে চলে আসে। সেই সময় দেবী দুর্গার গায়ের রংও হঠাৎ করে পরিবর্তিত হতে শুরু করে। অতসী বর্ণের বদলে টকটকে রক্ত বর্ণে পরিণত হয়। পাশাপাশি চণ্ডীপাঠ রত রাঘবরাম পুত্রের শরীরও তখন ফ্যাকাশে হতে শুরু করেছে। তাঁর দেহ ধীরে ধীরে রক্ত শূন্য হয়ে পড়ে। এরপর পরের দিন বিজয়া দশমীতে রীতি মেনে মা দুর্গা বিসর্জন যাত্রায় যান। অন্যদিকে রক্তশূন্য হয়ে প্রাণ হারান রামভদ্র। এরপর থেকেই এই পরিবারের দুর্গাপুজোয় চণ্ডীপাঠ বন্ধ হয়ে যায় এবং মা দুর্গা রক্তবর্ণর রূপেই পূজিত হয়ে আসছেন নবদ্বীপের এই ভট্টাচার্য পরিবারে।
আগে পুজোয় বলি প্রথা থাকলেও বর্তমানে শুধুমাত্র কুমড়ো বলি দেওয়া হয়। দেবী দুর্গার সামনে এবং দেবী দুর্গা পশ্চিম মুখী আসনে এখানে বিরাজ করেন। এই লাল দুর্গার ভোগেও রয়েছে অনেক বিশেষত্ব। নবমীর দিন দেবীর ভোগ হয় থোড় আর বোয়াল মাছ দিয়ে। এমন অদ্ভুত ভোগের নেপথ্যেও রয়েছে একটি অলৌকিক কাহিনী।
শোনা যায় কোন এক সময় রাঘবরাম ভট্টাচার্যের পুত্র রামচন্দ্র ভট্টাচার্য চার বছর ধরে আসাম রাজ্যের কামাখ্যা মন্দিরে দেবী কামাখ্যার পুজো করতেন। শোনা যায় এক নবমী তিথিতে কামাখ্যা মন্দিরের নীচে ভৈরবী মন্দিরে বালিকা রূপে দেবীর দর্শন লাভ করেন তিনি। দেবী নাকি রামচন্দ্রকে বলেছিলেন মন্দির সংলগ্ন ও সামনের পুকুরে ডুব দিলে তিনি সরাসরি পৌঁছে যাবেন তার বাড়িতে। সেখানে গিয়ে বাড়ির দেবী মূর্তির ঠোঁটে থোড় আর বোয়াল মাছের অংশ দেখতে পাবেন। দেবীরর গ্রহণ করা ওই থোড় আর বোয়াল মাছের অংশই সব সময় প্রসাদ হিসেবে দুর্গাপুজোয় ব্যবহার করতে হবে। প্রত্যেক বছর দেবীর ভোগে থোড় এবং বোয়াল মাছ দেওয়া হয়।
নবদ্বীপের এই পুজো যেমন একদিকে ওই অঞ্চলের বনেদি পরিবারের পুজোর রীতিকে রক্ষা করে অন্যদিকে অলৌকিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ করে। দূর-দূরান্ত থেকে ভ্রমণপিপাসুরা এখানে পুজো দেখতে আসেন। ভোগ গ্রহণ করেন। দেবীর মাহাত্ম্যে বিশ্বাস করেন ওই অঞ্চলের মানুষরা। এই লাল দুর্গাকে কেন্দ্র করে বহু মানুষের আশা-নিরাশার সুতো বাঁধা হয় আজও।
In English

