রায়বেশের দরবারে

বর এসেছে বীরের ছাঁদে,

বিয়ের লগ্ন আটটা।

পিতল-আঁটা লাঠি কাঁধে,

গালেতে গালপাট্টা।

শ্যালীর সঙ্গে ক্রমে ক্রমে

আলাপ যখন উঠল জমে,

রায়বেঁশে নাচ নাচের ঝোঁকে

মাথায় মারলে গাঁট্টা।

শ্বশুর কাঁদে মেয়ের শোকে,

বর হেসে কয় - ঠাট্টা!

‘খাপছাড়া’ কাব্য গ্রন্থে রায়বেশে নাচ-এর প্রসঙ্গ এনে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। রায়বেঁশে বা রায়বেশে নাচে মুগ্ধ ছিলেন কবি। বাংলার লোক সংস্কৃতির অঙ্গ প্রাচীন এই নাচ প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, " রকম পুরুষোচিত নাচ দুর্লভ; আমাদের দেশের চিত্তদৌৰ্ব্বল্য দূর করতে পারবে এই নৃত্য ”বাস্তবিক এই নৃত্য দেখলে এটাকে নটরাজ শিবের রণতাণ্ডব নৃত্যের অবিকল প্রতিরূপ বলে মনে হয়।

রায়বেশে নৃত্য শৈলির বয়স ১৭৫ বছরের কিছু বেশি।

প্রথম উদ্ভব হয়েছিল মুর্শিদাবাদের বড়জ্ঞা ও খড়গ্রাম অঞ্চলে। পরে বীরভূম, বর্ধমান রাঢ়ের জেলাগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। চর্চা বেশি শুরু হয় বীরভূমে।

‘রায়’ কথাটির অর্থ বড় বা সম্ভ্রান্ত। ‘বেঁশে’ এর অর্থ বাঁশ ব্যবহারকারী বা বাঁশ থেকে তৈরি। বাঁশের তৈরি শক্ত লাঠি নিয়ে ভয়ঙ্কর রোমহর্ষক নাচ হত। তাই রায়বেঁশে। ডোম এবং অন্ত্যজ মানুষরাই মূলত এই সংস্কৃতির প্রধান ধারক। তাদের শারীরিক সক্ষমতায় মুগ্ধ হয়ে ভূস্বামীরা স্বীকৃতি দিতেন।

পরিধেয় বলতে সাদা ধুতির  সঙ্গে কোমরে বাঁধা লাল ফেট্টি। সেটি কোমর বন্ধ হিসেবে ব্যবহার হলেও আসলে ছিল শৌর্য ও বীরত্বের চিহ্ন।

 বাংলার “রায়বেশে” যোদ্ধাদের বংশধর, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ হতে পারে না। কবিকঙ্কণচণ্ডী, ধৰ্ম্মমঙ্গল, অন্নদামঙ্গল ও কবি রামপ্রসাদের কাব্যগ্রন্থের মধ্যে প্রাচীন বাংলার “রায়বেশে” যোদ্ধাদের সমর-কৌশলের ও ঋবঙ্গলক্ষ্মী ৪—( ফাল্গুন ১৩৩৭ হইতে শ্রাবণ ১৩৩৮ ) “বেড়াপাকের" পদ্ধতিতে তাণ্ডবনৃত্যের যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়।

সম্মিলিত লোকনৃত্যের ধারাতে রণনৃত্যের শৈলী স্পষ্ট। সঙ্গে মিশেছিল শারীরিক কসরতের কলা কৌশল।

রায়বেশের কুশীলবরা ছিলেন মূলত জমিদারের লেঠেল। জমিদারের মনোরঞ্জনের জন্য তারা এই নৃত্য প্রদর্শন করত। জমিদার, রাজা-রাজড়াদের কাছ থেকে উপহারও পেত। বীরভূমের কীর্ণাহারের সরকার বংশের জমিদাররা রায়বেশেদের বসবাসের জন্য একটি গ্রাম দান করেছিলেন। গ্রামের নাম চারকল গ্রাম।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অস্তিত্বের সংকটে ভুগতে শুরু করে রায়বেশেরা। জমিদারী প্রথার অবসানে তা আরও রক্তাল্পতায় ভুগতে শুরু করে।

তিরিশের দশকে বীরভূমের জেলাশাসক গুরুসদয় দত্ত এই রণ নৃত্য শৈলীকে বাঁচিয়ে রাখতে উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ১৯৩২ সালে ব্রতচারী আন্দোলনের সূচনা হয়। এই আন্দোলনের প্রধান উদ্দেশ্য বাংলার লোক সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখা। তার জন্য তৈরি করা হয়েছিল বঙ্গীয় পল্লী সম্পদ রক্ষা সমিতি।

কিন্তু আধুনিক সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা সম্ভব হয়নি। এক সময় ৭-১০ টি প্রথম সারির দল ছিল। কিন্তু অর্থনৈতিক কারণে বেশির ভাগই অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন কুশীলবরা। মানুষের বিনোদনের ধরণ পাল্টে গিয়েছে।

তবে একেবারে লুপ্ত হয়ে যায়নি রায়বেশে। কসরত ও খেলা দেখার জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ডাক পড়ে তাঁদের। বিভিন্ন সরকারি অনুষ্ঠান ও উৎসবেও দেখা যায়। ছোট পর্দার নানা অনুষ্ঠানেও বাঁশের খেলা দেখাতে আসেন। সেভাবেই টিকে আছে প্রাচীন লোক সংস্কৃতির ধারাটি।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...