এক 'পেঙ্গুইন'-এর অবাক কাহিনি

"চারবছর আগেই আমার মৃত্যু হয়েছিল। একটা খুদে পাখি আমার জীবন ফিরিয়ে দেয়। পোষা নয়, সে বনের..."

"এ এক অদ্ভুত যন্ত্রণার কাহিনী। আনন্দের দিকও আছে।"

কথাগুলো স্যাম ব্লুমের। অস্ট্রেলিয়ার এক প্রাক্তন মহিলা সাঁতারু। বর্তমানে অস্ট্রেলিয় প্যারা সার্ফিং দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। ২০১৯ আর ২০২০ সালে ওয়ার্ল্ড প্যারাসার্ফিং চ্যাম্পিয়নশিপ প্রতিযোগিতায় সোনা জেতা প্রতিযোগী।

কীভাবে বদলে দিল একটা পাখি স্যামের জীবন সে গল্প জানতে হলে পিছিয়ে যেতে হবে বেশ কয়েক বছর।

Penguin1

২০১৩ সাল। গ্রীষ্মের ছুটিতে সেবার সপরিবারে থাইল্যান্ড বেড়াতে গিয়েছিলেন স্যাম।
তিন ছেলের বায়না ছিল অবশ্য অন্যত্র, কিন্তু থাইল্যান্ডের জল আর সমুদ্র টেনেছিল খুব।
নীলচে-সবুজ সমুদ্র। সাদা বালি। স্বপ্নের মতো দিন।

এত খুশি স্যাম কখনও হয়নি আগে। সমুদ্র তার জীবন। জল ছুঁয়ে বেঁচে থাকা।
ছোটবেলায় ভেবেছিল নার্স হবে, কিন্তু জলের টানেই 'সুইমার'।

ছুটির প্রথম দিন। সকাল হতেই ছেলেদের নিয়ে সমুদ্রে ঝাঁপ। সঙ্গে ফটোগ্রাফার স্বামী। সেও বেজায় জল ভালবাসে।
কয়েক ঘন্টা জলে সাঁতার।

ট্রপিক্যাল আবহাওয়ায় গরম বেশ। হোটেলের চারপাশ সবুজে ঘেরা। আনারসের ফার্ম। রবার গাছের ছায়া। দূরের লেকে গা ডুবিয়ে জল মহিষ।
প্রকৃতির এমন সৌন্দর্য স্যাম কম দেখেছে।

এই সব দেখাটাই তার হোটেলের ছাদ থেকে। সমুদ্রের লাগোয়া হোটেল। এমন সুন্দর যে ছাদ আছে জানা ছিল না। এটা ছেলের আবিষ্কার।
মাকে সঙ্গে নিয়ে স্পাইরাল সিঁড়ি দিয়ে ছাদে উঠেছিল ছেলে। ছুটির মেজাজ আরও ফুরফুরে।

Penguin2

হঠাৎ বজ্রপাত!
এমন ঝকঝকে হোটেলের ছাদ রেলিং যে এমন আলগা হতে পারে কে জানত!
জং ধরা রেলিং ভেঙে ২২ ফুট নীচে স্যাম। গোটাটাই ছেলের চোখের সামনে।
পরে থাই পুলিশের তদন্তে বেরিয়েছিল বহুদিন সারাইয়ের হাত পড়েনি রেলিং-এ।
রক্তাক্ত। সংজ্ঞাহীন স্যামকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল।
মাথা। কোমর। শিরদাঁড়া। বুক। সব জট। আঘাত অতি গুরুতর।

পরের মুহূর্তগুলো স্যামের স্বামী আর ছেলেদের কাছে দুঃস্বপ্নের মতো। কেউ জানে না কী হতে চলেছে আগামী।
প্রাণে অবশ্য বেঁচে গেলেন। তবে কোমর থেকে সব অবশ। সাড়হীন। আজীবনের মতো হুইল চেয়ারেবন্দী।
সেদিন রাতারাতি বদলে গিয়েছিল পৃথিবীটা। নিঃস্ব। রিক্ত। চূড়ান্ত অবসাদ।

স্যামের কাছে সমুদ্র তখন বিষ। তিনমাস টানা বিছানা। সব কিছু করিয়ে দিতে হয় তাকে।
নিজেকে একরকম মৃত বলেই মেনে নিয়েছিলেন এক কালের সমুদ্রপাগল সাঁতারু।
গল্পটা এভাবেই শেষ হতে পারত, তবে এখান থেকেই মোড় ঘুরল কাহিনীর।
চিত্রনাট্যে ঢুকে পড়ল একটা ছোট্ট ম্যাগপাই। বলতে পারেন একেবারে ঝুপ করে!
স্যামের তখন চেয়ার-জীবন। জানলা বন্ধ। ঘর অন্ধকার করে কেবল বসে থাকা।

একদিন বীচে বেড়াতে গেল ছেলেরা। সেখানে একটা পাইন গাছের তলায় খুঁজে পেল ছোট্ট একটা পাখির ছানাকে।
ক্ষতবিক্ষত। গাছের ডালে চাপা। থরথর করে কাঁপছে।

৬০ ফুট উঁচু পাইনগাছ। বাসা সমেত উপড়ে পড়েছে। কীভাবে যে প্রাণে বেঁচেছিল সেটাই আশ্চর্য!
ছানাটাকে কুড়িয়ে এনেছিল তিন ভাই আর তাদের বাবা।

প্রথমে চিকিৎসকের কাছে। কিন্তু একে অতটুকু পাখি তাতে বাঁচার আশা একেবারেই নেই, তাই কেউ আর হাতে নেয়নি তাকে।
শেষমেশ তাকে বাড়িতেই আনতে হল তাদের।

সাদা-কালো পালক ঢাকা গা। শক্ত দাঁত। ভাঙা ডানা। ছেলেরা তার নাম রেখেছিল 'পেঙ্গুইন'। তারা মহাখুশি নতুন সঙ্গীকে নিয়ে।
তাদের মা কিন্তু একটুও খুশি হল না। রাগ আর বিরক্তি দুই এল শুরুর দিকে।
তারপর যেন কেমন একটা ম্যাজিক ঘটে গেল!

পুরো বাড়ির সঙ্গে জড়িয়ে গেল অতিথি ম্যাগপাই। বিশেষ করে স্যামের সঙ্গেই!
ডানা ভাঙা পাখি। উড়তে পারত না। গোটা বাড়ি জুড়ে তার অবাধ বিচরণ।

দু'ঘন্টা অন্তর অন্তর খাওয়াতে হত তাকে। নাহলেই তারস্বরে চিৎকার। তার ওই চিৎকার থামাতেই স্যাম খাওয়াতে শুরু করল তাকে। ছেলেরা স্কুল চলে গেলে 'পেঙ্গুইন' তার কেয়ারে।

ম্যাগপাইটার ওপর কেমন মায়া পড়ে গেল তার। চোখের আড়াল হলে স্যামের চোখ অস্থির হয়ে যায়। তত হুইলচেয়ার সচল হয়ে ওঠে।

Penguin3

আদরের 'পেঙ্গি' তার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরত। কখনও কাঁধ, কখনও মাথা কখনও কোল সব জায়গা তার দখলে।
এই পাখিটার সঙ্গে দিনের অনেকটা সময় কেটে যেত স্যামের। ধীরে ধীরে সচল হতে শুরু করেছিল তার অচল আড়ষ্ট শরীর।
পেঙ্গুইন একাই বদলে দিচ্ছিল বাড়ির প্রতিদিনের ছবিটা। মুষড়ে পড়া বাড়িটা ফের চনমনে।
প্রত্যেকদিন ডানা ঝাপটিয়ে ওড়ার চেষ্টা করত সে। পারত না। কিন্তু চেষ্টা থামাত না।
সেই ইচ্ছেটা যেন ছড়িয়ে পড়েছিল স্যাম ব্লুমের অনিচ্ছুক মনেও।
শুরু হল ফিজিওথেরাপি। এক্সারসাইজ।

কায়াকিং প্র্যাকটিস শুরু করলেন। ফের ফিরে এল জলের জীবন।
বাচ্চা পেঙ্গির ততদিনে ডানা শক্ত হয়েছে। ঠোঁটও পোক্ত। ঘরের বাইরের টানটা ক্রমশ বাড়ছিল।
তারপর একদিন সত্যি সত্যিই উড়ে গেল সে। মুক্ত আকাশে ডানা ঝটপটিয়ে।
স্যামের কথায়, "পেঙ্গি যেদিন সত্যি উড়তে পারল, কী যে খুশি হয়েছিলাম! আমার তিন সন্তানের জন্মের সময়ও বোধহয় এমন বাঁধভাঙা খুশি আসেনি!"

পাহাড়ের কোলে জঙ্গলে নিজের ঘর বাঁধছিল ম্যাগপাই। আর সেই সময়টা নিজের পৃথিবীতে ফিরছিলেন স্যামও।
কায়াকিং-এ জাতীয় সেরা হয়েছিলেন। অস্ট্রেলিয়ার প্যারা কার্ফিং দলে সুযোগ এল। পাড়ি দিলেন ইতালি। জাতীয় চ্যাম্পিয়ন।
আর ফিরে আসেনি 'পেঙ্গুইন'। কিন্তু স্যাম জানেন সে কোনওদিন ভুলতে পারবে না স্যামকে। পাখিরও যে স্মৃতি থাকে...তাই ভুলতে পারে না ভালবাসা...

স্যাম আর পেঙ্গুইনের আশ্চর্য কাহিনী নিয়ে তৈরি হয়েছে সিনেমা। সম্প্রতি সে ছবি মুক্তিও পেয়েছে। ছবির নাম "পেঙ্গুইন ব্লুম"।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...