কালী কথা: নাক কাটা কালী মন্দির

বঙ্গ কেবল কালীর দেশ নয়, বিচিত্র-ব্যতিক্রমী কালীর দেশও বটে। পুরুলিয়া শহরের সাত নম্বর ওয়ার্ডের মধ্য পল্লীর পাঁড়ে গলিতে রয়েছে মা কালীর মন্দির। দেবীর নাম নাক কাটা কালী। মন্দিরটিও নাক কাটা কালী মন্দির নামে পরিচিত। পুরুলিয়ার প্রাচীন মন্দিরগুলোর মধ্যে অন্যতম এই নাক কাটা কালী মন্দির। চারপাশে ফাঁকা খেতের মাঝে একটি ছোট্ট টিলার উপরে মন্দির, তাতেই দেবী অধিষ্ঠিত। বহুকাল আগে মন্দিরটি ছিল পাথরের। এখন স্থায়ী পাকা মন্দির তৈরি হয়েছে। বৈশাখ মাসে মেলা বসে। তা নাক কাটা কালী মেলা নামে পরিচিত। সাত দিন ধরে উৎসব হয়।

Nak Kata Kali temple

প্রায় দুশো বছর ধরে পাথরের মূর্তিকেই মা কালী হিসাবে পুজো করে আসছেন ভক্তরা। ভক্তদের বিশ্বাস, নাক কাটা কালী জাগ্রত। এখানে মানত করলে তা পূর্ণ হয়। পুজোর দিনে মানুষের ঢল নামে মন্দিরে। চাষিরা নিজেদের জমিতে মায়ের পুজো শুরু করেছিলেন। আজও মন্দিরের ভিতরে মায়ের পুরনো ভেঙে যাওয়া পাথরের মূর্তি রয়েছে। স্থানীয় মানুষের মতে, পাথরের মূর্তি নাকি অষ্টাদশ শতাব্দীর। সেই সময় পুরুলিয়ায় আধিপত্য ছিল জৈনদের। আজও প্রাচীন রীতি মেনে এখানে দেবী কালীর পুজো হয়। লোক মুখে শোনা যায়, মন্দিরকে ঘিরে থাকা একটি অশ্বত্থ গাছ যেন প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে মন্দিরকে রক্ষা করছে। কোনও পাকা মন্দির নেই। বিগত কয়েকশো বছর ধরে চিড়াবাড়ি এলাকায় অশ্বত্থ গাছের কাঠামোর ভেতর দেউলিয়া নাক কাটা কালী হিসাবেই পূজিতা হয়ে আসছেন মা। 

মন্দিরের সামনে আছে দু’‌টি বিরাট আকারের পাথর। তাতে স্পষ্ট পায়ের ছাপ। 

Nak Kata Kali temple 2

কেন এমন হল দেবীর নাম? আজ থেকে প্রায় দুশো আড়াইশো বছর আগে ওই অঞ্চল ছিল নির্জন, জনমানবহীন। এলাকা জুড়ে ছিল বিঘের পর বিঘে জমি, মূলত কৃষি। সেখানে ধান চাষ হত। জনশ্রুতি অনুযায়ী, ধান লুঠ করতে এক কালীপুজোর আগের রাতে আক্রমণ করে এক দল ডাকাত। বাধা হয়ে দাঁড়ান মা কালী। ডাকাত দল তরোয়াল দিয়ে মায়ের নাক কেটে দেয়। তারপর থেকে টিলার ওপরে মায়ের পাথরের মূর্তিকে পুজো করা হয়। পাথরের গায়ে মায়ের যে অবয়ব ফুটে উঠেছে সেখানে দেবীর নাক কাটা। কথিত আছে, মায়ের মায়ের নাক ও গলা আজও পড়ে আছে মন্দিরের ভিতরে। মন্দির চত্বরে রয়েছে দেবীর বিশালাকার পায়ের অংশ, প্রায় এক ফুট লম্বা জিভ ও অন্যান্য অঙ্গ। সেগুলিরও পুজো হয়।

আর একটি কিংবদন্তি অনুযায়ী, প্রায় দুশো বছর আগে জমির পাকা ধান বাঁচাতে গিয়ে ডাকাতদের হাতে নাক খোয়ান পুরুলিয়া চিড়াবাড়ির দেউলিয়া কালী। সেই থেকে কাটা নাকের কালী মূর্তির পুজো হয়ে আসছে। পুরুলিয়া শহরের চিড়াবাড়ি এলাকায় ছিল বেলবেড়িয়া কালী বাড়ি। সেই মন্দিরেই এলাকার মানুষ কালীর পুজো করতেন। বিরাট আকৃতির পাথরের কালী মূর্তি পুজো করা হত। লোকমুখে প্রচলিত কাহিনি অনুসারে, স্বপ্নাদেশে ধানের জমিতে ডাকাত পড়ার খবর গৃহস্থকে জানিয়ে দেন চিড়াবাড়ির দেউলিয়া কালী। সেই স্বপ্নাদেশ পেয়ে ছুটে আসেন চাষিরা। ধান কেটে নিয়ে যেতে না-পারায় ক্ষোভে ধারালো অস্ত্র দিয়ে মায়ের মূর্তিতেই আঘাত করে ডাকাতের দল। খণ্ড খণ্ড হয়ে যায় মায়ের মূর্তি। টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে দেবীর পাথরের মূর্তি। কাটা যায় প্রতিমার নাক। জমির মালিকরা মন্দিরে দেবী মূর্তির অবস্থা দেখে অবাক হয়ে যান। সেই থেকে মা নাক কাটা কালী নামে পূজিতা হয়ে আসছেন। এই ঘটনার পর একে একে ডাকাতদলের সদস্যদের সঙ্গেও অঘটন ঘটে। মৃত্যু হয় তাদের, পরিবারে অভাব অনটন দেখা দেয়।  

 

স্থানীয় চাষিরাই পুজোর দেখাশুনা করত। এখন প্রথা মেনে প্রতিদিনই কালীর পুজো হয়। প্রতি সপ্তাহের মঙ্গল ও শনিবার পাথরের মূর্তিতে মায়ের বিশেষ পুজো হয়। কার্তিকের দীপান্বিতা অমবস্যায় মহাসমারোহে নাক কাটা কালীর পুজো হয়। পুজোর রাতে ভিড় উপচে পড়ে। বলিদানও চলে। কালীপুজোর রাতেও পাঁঠা বলি হয়। সোনার গয়নায় সেজে উঠেন নাক কাটা কালী। পুজোকে কেন্দ্র করে দু’দিন পংক্তি ভোজন হয়। পুজো শেষে মধ্যরাতে খিঁচুড়ি প্রসাদ পান মানুষ। পুজোর পর দিন বলির মাংস দিয়ে খিঁচুড়ি রাঁধা হয়। প্রসাদ খেতে ভক্তরা ভীড় জমান নাক কাটা কালী মন্দিরে। কালী পুজোর সময় চারদিন ধরে চলে পুজো। কালীপুজোর দিন উৎসবের চেহারা নেয় এই মন্দির। জেলা ছাড়িয়ে ভিন রাজ্য থেকেও পুজো দিতে আসেন বহু পুণ্যার্থী। ধানবাদ, বোকারো, চাস, টাটা, হাজারিবাগ থেকে ভক্তেরা পুজো দিতে এখানে আসেন। মানত করেন। কালী মন্দিরের সঙ্গে রয়েছে শিব ও বজরংবলির মন্দির। তাঁরাও পুজো পান।

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...