হুগলি জেলার আরামবাগে রয়েছে তিরোল গ্রাম। প্রায় ছশো-সাতশো বছর ধরে এই গ্রামেই পুজো পাচ্ছেন মা ক্ষ্যাপাকালী। তিনি এই গ্রামের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। আদপে এই কালী হলেন সিদ্ধেশ্বরী কালী। এককালে দেবীর মৃন্ময়ী মূর্তি পূজিতা হলেও বর্তমানে কষ্টিপাথরের মূর্তি পূজিত হয়। দেবীর দুই দিকে রয়েছে ডাকিনি ও যোগিনী। এই কালী তিরোলের জমিদার বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। জনশ্রুতি রয়েছে, এক সাধু দেবীর পুজো করতেন। তিনি যখন মৃত্যুপথযাত্রী, তখন তাঁকে দেবী স্বপ্নাদেশ দিয়ে পুজোর দায়িত্ব তিরোলের জমিদার চক্রবর্তী পরিবারের হাতে তুলে দিতে বলেন। আঠারো শতকে সৃষ্টিধর চক্রবর্তী জনৈক এক সাধুর হাত থেকে কালী মূর্তি ও পুজোর দায়িত্ব পান। একটি কিংবদন্তি অনুসারে, প্রায় ৮০০ বছর আগে স্বপ্নাদেশ পেয়ে এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন জমিদার দীননাথ চক্রবর্তী। প্রায় সাত পুরুষ ধরে দেবী ক্ষ্যাপা কালীর পুজো করে আসছে চক্রবর্তী পরিবার।
শোনা যায়, মা কালীর হাতে পরানো হয় লোহার বালা। সেই বালা তৈরি করেন এক কর্মকার পরিবার। তিরোল গ্রামের ক্ষ্যাপাকালীর বালার মাহাত্ম্য অপরিসীম। কথিত আছে, দেবী কালীর হাতের বালা পরলে নাকি মানসিক ভারসাম্যহীন রোগীরা সুস্থ হয়ে যান। মায়ের মন্দির থেকে হাতের বালা দেওয়া হয়, যা পড়লেই সুস্থ হয়ে যান মানসিক ভারসাম্যহীন রোগীরা। পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাওয়ার পরেই এই বালা খোলা যাবে। কেউ কেউ বলেন এক বছর হাতে বালা পরতে হয়। ক্ষ্যাপা মানুষ সুস্থ হয়ে যায় তাই দেবীর নাম ক্ষ্যাপাকালী। সুস্থ হলে বালা আবার মন্দির প্রাঙ্গনে ফেরত দিয়ে আসতে হয়। মন্দিরে এমন প্রচুর বালা দেখতে পাওয়া যায়। যা সুস্থ হয়ে মানুষ ফিরিয়ে দিয়ে এসেছেন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোটগল্প তিরোলের বালাতেও দেবী ক্ষ্যাপাকালীর কাহিনি রয়েছে।
কথিত আছে, মা সারদামণি তাঁর মানসিক ভারসাম্যহীন ভাইঝি রাঁধুকে এই মন্দিরে এনে বালা পরান। তারপর নাকি সুস্থও হয়ে যান রাঁধু। আবার অন্য একটি কাহিনি অনুসারে, সারদামণির বৌদি মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছিলেন। তিনি তাঁর বৌদিকে নিয়ে এই মন্দিরে আসেন এবং দেবীর আশীর্বাদে তিনি সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন। মা সারদামণি তিরোল গ্রামের ক্ষ্যাপাকালীকে পুজো দেন।
জনশ্রুতি অনুযায়ী, অনেক বছর আগে এক কালীপুজোর রাতে তিরোল কালীর প্রতিষ্ঠাতা সাধক মানগোবিন্দ মিত্রের কাছে একটি সদ্য বিবাহিত মেয়ে এসে তার বিকৃত মস্তিষ্ক স্বামীর জন্য বালা প্রার্থনা করে। মেয়েটি নিজের মাথার সোনার টিকলি দক্ষিণা হিসেবে দিতে গেলে সাধক তা নিতে অস্বীকার করেন। মেয়েটি চলে যাওয়ার পর সাধক যখন মন্দিরে প্রবেশ করেন, তখন তিনি দেখেন, দেবী বিগ্রহের মাথায় মেয়েটির সেই সোনার টিকলিটি! তিনি বুঝতে পারেন, স্বয়ং দেবী তাঁকে দেখা দিয়েছেন। আজও প্রথা মেনে কালীপুজোর দিন মা কালীর মাথায় সেই টিকলি পরানো হয়।
নিত্য পুজো পান দেবী ক্ষ্যাপাকালী। প্রতি অমাবস্যায় মন্দিরে বিশেষ পুজো হয়। কার্তিক মাসের অমাবস্যায় দেবীর বিশেষ পুজো হয়। দীপাবলির সময় দেবীর প্রিয় সানাই বাজানোরও রীতি রয়েছে এখানে। ২০ থেকে ২৫ বছর অন্তর বদলানো হয় দেবীমূর্তি। দীপান্বিতা কালীপুজোর সময়ে তারকেশ্বরের দশঘড়ায় বিশ্বাস পরিবারের দুর্গাপ্রতিমাকে পরানো মুকুট ক্ষ্যাপাকালীর মাথায় পরানো হয়। সেই মুকুট সারা বছর সিদ্ধেশ্বরী মায়ের মাথায় শোভা পায়। আজও মন্দিরে বলিদানের প্রথা রয়েছে। কার্তিক মাসে শ্যামা পুজোর সময় ঘট তোলেন চক্রবর্তী বংশের বয়োজেষ্ঠ্য পুরুষ। আজও মানুষের বিশ্বাস, মায়ের কাছে নিয়ে এলেই ভারসাম্যহীনরা সুস্থ হয়ে ওঠেন। এই বিশ্বাস বুকে নিয়ে এখনও মানুষ আসেন। দেশের নানা প্রান্ত এমনকী বিদেশ থেকেও মানসিক ভারসাম্যহীন রোগীদের আত্মীয়রা রোগীদের সুস্থ করতে এই মন্দিরে দেবী কাছে ছুটে আসেন।