মা গঙ্গা এসে ধরা দিয়েছিলেন পরম সাধক ভগবানদাস বাবাজীর কাছে!

ঊনবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় পাদের অন্যতম বৈষ্ণব সাধক ছিলেন শ্রী ভগবান দাস বাবাজী। তিনি নিজে ছিলেন ভক্তনিষ্ঠ এবং তার অনুগত ভক্ত ও সংশ্লিষ্ট শিষ্যদের জীবনে অকপট ভজন নিষ্ঠা ও শুদ্ধাচারী জীবনের আদর্শকে রূপায়িত করবার উপর তিনি সবথেকে বেশি জোর দিতেন। 

ভগবান দাস বাবাজী ছিলেন একজন পরম বৈষ্ণব, নিজের ভজন সিদ্ধি ও মানসিক শক্তির বলে গৌড়ীয় সমাজের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আচার্য রূপে তিনি পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর দাসানুদাস ভগবান দাস বাবাজীশ্রী শ্রী নাম ব্রহ্মবিগ্রহের সেবা প্রবর্তন করেন। রাগানুগা ভজনের নিগূঢ় ধারা পথে ভগবান দাস বাবাজীএকনিষ্ঠ সাধনা করতেন।

তাঁর সাধনা এতটাই গোপনে চলত যে, তিনি তার বাহ্যিক আচার-আচরণের মধ্যে দিয়ে ভক্তি রসাবশের চাঞ্চল্য খুব একটা বড় প্রকাশ করেননি,তাই তার ভক্তরা তাকে ভক্তি রসে আপ্লুত হতে কখনও দেখেননি। নিজেকে গোপন রাখতে বিশেষভাবে সচেষ্ট হলেও তাঁর আচার-আচরণের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হত সাধনার কত উচ্চতম পর্যায়ে তিনি পৌঁছে গিয়েছিলেন। ভেদ বুদ্ধি, জাত বুদ্ধির ঊর্ধ্বে উঠে তিনি হতে পেরেছিলেন এক মহাসাধক।

07176742-2f20-431e-b599-1ad65ed35d35

১৮০৩ খ্রিস্টাব্দে উড়িষ্যার ধারেন্দার বাহাদুরপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ভগবান দাস বাবাজী। জন্মের পর থেকেই তার আচার-আচরণের মধ্যে ভক্তি ভাব লক্ষ্য করা যায় এবং আনুমানিক ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি পরিবার এবং নিজের জন্মভূমি চিরতরে ত্যাগ করে বৃন্দাবন ধামে এসে উপস্থিত হন, এরপর তার ইষ্ট গোবিন্দের সেবা করে তিনি গোবিন্দ মন্দিরের পরিচায়ক হয়ে ওঠেন, মন্দিরের সাধক সিদ্ধ কৃষ্ণ দাস তার সেবায় তুষ্ট হয়ে তাকে কৃষ্ণমন্ত্রে দীক্ষিত করেন। ‌

আনুমানিক ১৮৩৩ থেকে ৩৪ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ৩০ বছর বয়সে ভক্তি মার্গে উত্তীর্ণ হয়ে গুরু কৃষ্ণদাসের নির্দেশে কালনায় মহাপ্রভুর মন্দিরে আশ্রয় গ্রহণ করেন তিনি ও সর্বদা সাধন-ভজনে ডুবে থাকতে শুরু করেন। ভগবান দাস বাবাজীর বেশ কয়েকটি ঘটনা তার লীলা মাহাত্ম্যকে বর্ণনা করে, যে ঘটনাগুলি শুনলে আপনারা‌ও বুঝতে পারবেন কঠোর তপঃ শক্তি থাকা সত্ত্বেও মহাসাধকের বিনয় এবং নম্রতা কীভাবে নিজের জীবনের মধ্যে ফুটিয়ে তুলেছিলেন ভগবান দাস বাবাজি।  

কালনার শ্রীপাটে ভক্ত ও বৈষ্ণব জন সবসময় আসা-যাওয়া করেন। কারণ সেখানে যে বৈষ্ণব সাধক ভগবান বাবাজী রয়েছেন, তিনি সবসময় ভগবানের নাম জপ করে চলেছেন তাই পরম এই বৈষ্ণব সাধক কে দেখতে ভক্ত বৈষ্ণবের ভিড় থাকবে এ তো স্বাভাবিক! 

একদিন এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল এইখানে! বাবাজীতার ভজন কুটিরে বসে ভগবানের নাম স্মরণ করছিলেন, মালা জপ করছিলেন হঠাৎ করে সেখানে এসে উপস্থিত হলেন বর্ধমানের মহারাজা। তাকে দেখে বাবাজী এক অদ্ভুত কান্ড ঘটান।

হাতের মালাটি আসনের উপর রেখে তিনি চিৎকার করে ওঠেন,‘ ওরে মার!মার! তাড়িয়ে দে!তাড়িয়ে দে!’ এই কথা শুনে সেখানে উপস্থিত সবাই অবাক হয়ে গেলেন এবং বর্ধমানের মহারাজা স্বাভাবিকভাবেই ভয়ংকর ভাবে ক্ষুব্ধ হয়ে গেলেন। তিনি বিষয়ী ও ধনী লোক বলেই কি সাধু বাবার তার উপর এত ক্রোধ! কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই ভগবান দাস মালাটি আবার হাতে তুলে মহারাজকে বললেন, বাবা কতক্ষণ আসা হয়েছে?

মহারাজ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, প্রভু আমাকে তাড়িয়ে দিতে চাইলেন কেন? ভগবান দাস মৃদু হেসে বললেন,“ না বাবা আপনাকে তাড়াব কেন? বৃন্দাবন ধামে গোবিন্দজীর মন্দিরে তুলসী মঞ্চের ওপর উঠে একটা ছাগল তুলসী গাছের পাতাগুলো খেয়ে ফেলেছিল। প্রভুর সেবায় বিঘ্ন হবে বলে আমি ওটাকে তাড়িয়ে দিচ্ছিলাম।” বর্ধমান রাজা ভাবলেন এটা কীভাবে সম্ভব?- তাঁর মনে সন্দেহ দেখা দিলো যে সত্যিই কি ভগবান দাস বাবাজী এই কালনায় বসে বৃন্দাবনের সমগ্র ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন? নাকি তিনি বানিয়ে বানিয়ে আজগুবি ঘটনা বলছেন! তাই তিনি বৃন্দাবনের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর কাছে তৎক্ষণাৎ টেলিগ্রাম পাঠালেন, সমস্ত বিষয়টি জানার জন্য।

জবাবে জানা গেল যে, ঠিক সেই সময় গোবিন্দজীর তুলসী মঞ্চের গাছটি একটি ছাগল খাচ্ছিল। কালনানিবাসী ভগবান দাস বাবাজীআকস্মাৎ সেই সময় স্থূল দেহে সেখানে উপস্থিত হয়ে ছাগলটিকে তাড়িয়ে দেন। এই অলৌকিক ঘটনার কথা শুনে বর্ধমানরাজ বিস্মিত হয়ে গেলেন! তিনি বুঝতে পারলেন ভগবান দাস বাবাজী সত্যি একজন মহাত্মা এবং তিনি মহাবৈষ্ণব।

এই ভগবান দাস বাবাজীর সঙ্গে একবার বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী সাক্ষাৎ হয়েছিল। ‌ বিজয় কৃষ্ণ গোস্বামী ভগবান দাস বাবাজির নাম মাহাত্ম্য শুনে তাকে দর্শন করতে স্বয়ং কালনা এসেছিলেন। গোস্বামীজী একজন ব্রাহ্ম সমাজের প্রচারক, তিনি পথ শ্রান্ত এবং পিপাসার্ত তাই আশ্রমের এক সেবকের কাছে পানীয় জল চাইলেন কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে ভগবান দাস বাবাজীতখন কুটির থেকে বেরিয়ে এলেন এবং নিজের করঙ্গখানি সযত্নে ধুয়ে বিজয় কৃষ্ণের জন্য জল নিয়ে এলেন সঙ্গে সঙ্গে মিষ্টান্ন প্রসাদেরও ব্যবস্থা করলেন। বিজয় কৃষ্ণ ভগবান দাস বাবাজির এই আচরণে যথেষ্ট অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন যে,“ আমি ব্রাহ্ম, জাত ভেদ মানি না।‌যার তার ছোঁয়া খায়। আমাকে আপনার করঙ্গ থেকে জল পান করতে দেবেন?

দৈন্য ও বিনয়ের জীবন্ত প্রতিমূর্তি মহাসাধক ভগবান দাস এই কথা কানে শুনে যেন সংকচে মরমে মরে গেলেন। তিনি বললেন,‘ প্রভু জাতি বুদ্ধি ও ভেদ থাকতে কি আর ভগবানের কৃপা হয়? এ অধমকে আর পরীক্ষা করবেন না! কৃপা করে জল পান করুন।’

বিজয় কৃষ্ণের জল পানের পর ভগবান দাস করঙ্গের অবশিষ্ট জল টুকু পরমানন্দে পান করলেন। এই দুই মহাসাধকের মিলন সময়ে সেই আশ্রমে আরও কিছু মানুষ উপস্থিত ছিলেন, তারা তখন ব্যঙ্গ ভরে উক্তি করলেন,“ গোস্বামী মশাই দেখছি ব্রাহ্মণ হয়েও গলার উপবীত ত্যাগ করেছেন!” বাবাজীমহারাজ তাদের বাধা দিয়ে বললেন,“ আহা অমন কথা বলো না। উনি ব্রাহ্ম হলেও মহা সাধক। ব্রাহ্মসমাজের আচার্য বলে সম্মানিত। অদ্বৈত সন্তানের কী মহিমা!”

আবার কেউ মন্তব্য করলেন,“ কেমন আচার্য তা তো দেখাই যাচ্ছে জামা জুতো পরা মডার্ন আচার্য” ভগবান দাস তখন অশ্রুসিক্ত নয়নে বললেন,“ এ কথা বলা মহা অপরাধ। এই সাধক মহাপুরুষকে উপযুক্ত মর্যাদা দেওয়া আমাদের অবশ্য কর্তব্য। আমরা তো কিছুই করতে পারলাম না। ইনি নিজে সমাজে প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছেন আপন সাধনার বলে, সেইটুকু আমাদের সহ্য হচ্ছে না”- এই ছিলেন ভগবান দাস বাবাজি, যিনি ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের সমাধির অবস্থা দেখে ঠাকুর কে বলেছিলেন,“ আপনি মহাপুরুষ চৈতন্যদেবের আসনে বসবার আপনিই উপযুক্ত!”

এই সাধকের জীবন সম্পর্কে শোনা যায় যে, মা গঙ্গা স্বয়ং এসে ধরা দিয়েছিলেন তাঁর কাছে! হ্যাঁ,প্রতিদিন সকালবেলায় তিনি গঙ্গা স্নান সেরে অপরাহ্ণে মহাপ্রভু মন্দিরের পাঠানো প্রসাদ নিজের পোষ্য বিড়াল ও কুকুরকে খাইয়ে কনা মাত্র যা থাকত তাই নিজে গ্রহণ করতেন, তবে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দূরে গঙ্গার পথে হেঁটে যেতে কষ্ট হতো তাঁর, সময়ও বহু লাগত। তাই প্রতিদিন স্নানের পূর্বে দেবী গঙ্গাকে প্রার্থনা করতেন,“ আর যে পারি না মাগো, আবার না এসেও থাকতে পারি না যে, কিছু একটা ব্যবস্থা করো মা।” ভক্তের আকুলতা ফেরাতে পারেননি মা গঙ্গা। বর্ষার কারণে একবার গঙ্গাস্থানে সত্যিই যেতে পারেননি তিনি, সেই বছর আশ্রমের কুয়োর সিঁড়ি দিয়ে নেমে স্নান করতে গিয়ে দেখলেন গঙ্গার গৈরিক রঙের জলে পূর্ণ হয়ে গেছে কুয়া। অর্থাৎ মাইল খানিক দূরত্বে থাকা গঙ্গাও তার ভক্তি নিষ্ঠা এবং শরণাগতির আকুতি দেখে তাঁর কাছে নিজে এসে ধরা দিয়েছিলেন ইনি ছিলেন ভগবান দাস বাবাজি।

ইংরেজি ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দ( বাংলার ১২৯০ বঙ্গাব্দে) মহাপ্রয়াণ ঘটে তাঁর। এরকম একজন সাধকের প্রয়াণে ভক্তি জগতের ভক্তদের মাঝে তৈরি হয় হাহাকার!

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...