ঠাকুরবাড়ির 'মনীষা'

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের তৃতীয় পুত্র হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চতুর্থ কন্যা মনীষা দেবী। প্রতিভা ও অভিজ্ঞার সঙ্গীতের উত্তরাধিকার ছিল তাঁর মধ্যে।

গানের বাড়ি জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি। দ্বিজেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তো বটেই সৌদামিনী, স্বর্ণকুমারীরাও গান লিখেছেন, সুর দিয়েছেন এবং ব্রাহ্মসমাজে ও পারিবারিক অনুষ্ঠানে তা গাওয়া হয়েছে। সর্বোপরি রবীন্দ্রনাথ তখন একের পর এক গান রচনা করছেন, লিখছেন গীতিনাট্য, অভিনয় হচ্ছে নিয়মিত।

এই আবহে বড় হয়ে উঠলেও মণীষার মন টেনে ছিল পাশ্চাত্য শাস্ত্রীয় সঙ্গীত আর পিয়ানো। পরবর্তী সময়ে তিনি পিয়ানো চর্চাই বেশী করেছেন। লরেটোর ছাত্রী মনীষা রবীন্দ্রনাথের বেশ কিছু গান পিয়ানোয় সঙ্গতও করেছেন। তার অন্যতম 'পাদপ্রান্তে রাখো সেবকে /শান্তি সদন সাধনধন দেব দেব হে' ইত্যাদি।

বেদমন্ত্রেও তিনি পিয়ানো সঙ্গত করেছিলেন। মনীষা এ দেশে তেমন পরিচিত ছিলেন না। অভিজাত মণ্ডলীর বাইরে পিয়ানোচর্চা আমজনতার দরবারে আজ ও পৌঁছোয় নি। তাই মণীষার পরিচয় তাঁর স্বদেশে আড়ালেই রয়ে গিয়েছে।

মনীষা খ্যাতি পেয়েছিলেন বিদেশে, সাগরপাড়ে। বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে বিদেশ গিয়েছিলেন তিনি। তাঁর চিকিৎসক স্বামী দেবেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল মণীষার দিদি অভিজ্ঞার। বিয়ের এক মাসের মধ্যে ক্ষয়রোগে তাঁর মৃত্যু হলে মণীষার সঙ্গে দেবেন্দ্রনাথের বিবাহ হয়।

বিদেশে মণীষার পিয়ানো বাদন প্রভূত প্রশংসা পেয়েছিল। এদেশে বসে পিয়ানো চর্চা করা আর ইয়োরোপীয়দের খাস তালুকে অচেনা মানুষজনকে পিয়ানো শোনানোর মধ্যে অনেক ফারাক। মনীষার নিখুঁত, গভীর ও আন্তরিক বাদনে মুগ্ধ হয়েছিলেন গুণীজনেরা। এমনই একজন মনীষী ম্যাক্সমূলার। পাশ্চাত্য সুর ছাড়াও মণীষা পিয়ানোয় বাজাতেন ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত।

সেকালে পশ্চিমী দুনিয়ায় সে সুর ছিল অচেনা। পাশ্চাত্য এই যন্ত্রে প্রাচ্য দেশের অজানা সুর আরও অনেকের মতো মুগ্ধ করেছিল ম্যাক্সমূলারকেও। ১৮৮৯-এর ২৮শে জানুয়ারি অক্সফোর্ড থেকে যে চিঠি তিনি মণীষা দেবীকে লিখেছিলেন তার ছত্রে ছত্রে মণীষার অনবদ্য বাজনার প্রশংসা ও মুগ্ধতা প্রকাশিত হয়েছে।

ভারতীয় সঙ্গীত চর্চাও করেছিলেন মণীষা। 'সঙ্গীত সম্মেলনী'-তে সখী প্রমদা চৌধুরীর সূত্রে যুক্ত ছিলেন তিনি। তাঁর লেখার ভাষা ছিল সহজ, সরল। 'তত্ত্ববোধিনী' পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর 'নববর্ষে প্রার্থনা' লেখাটিতে তাঁর মনের গভীরতা ধরা আছে। এ ছাড়া 'পুণ্য' পত্রিকায় সেলাই সংক্রান্ত লেখা 'পুঁতির পরদা' লিখেছেন তিনি। সেকালে পুঁতির পর্দা ছিল আভিজাত্যের লক্ষণ। শুধু কথায় নয়, মণীষা শেখাতেন ছবি এঁকে, যাতে বুঝতে সুবিধে হয়।

স্বামী দেবেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের সূত্রে মণীষা থাকতেন শিলঙে। ১৯২৩ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন শিলঙ যান তখন তিনি দেবেন্দ্রনাথ-মণীষার বাড়ি 'জিৎভূমে' থেকেছিলেন। এই বাড়িতে থাকার সময় তিনি 'রক্তকরবী' ও 'শিলঙের চিঠি' লেখেন। 'শেষের কবিতা' উপন্যাসে লাবণ্য-র বাড়ির বর্ণনায় 'জিৎভূম'-এর ছায়া আছে। দেবেন্দ্রনাথের ক্ষয়রোগে মৃত্যুর পরও মণীষা 'জিৎভূম'-এ থাকতেন। ম্যাক্সমূলারের প্রশংসা মণীষাকে কতখানি প্রভাবিত করেছিল তা জানা যায় না।

নিজের কথা প্রকাশ করেননি কোথাও। সুরের যে ধারা জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে নিত্য প্রবহমান ছিল সেই ঝর্ণাতলায় নির্জনে আপন মাটির কলসখানি পেতেছিলেন মণীষা, আপন আনন্দে দেশের সুরকে বিদেশের বাজনায় ধ্বনিত করেছিলেন - 'আনন্দোদ্ধেব খল্বিমানি ভূতানি জায়ন্তে'- সুরের আনন্দধারায় স্নাত হতে চেয়েছিলেন মণীষা দেবী, সেখানেই তাঁর সার্থকতা।।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...