"বেথুন কলেজে অমিয়া রায় বলে একটি মেয়ে আছে, তার গলা ঝুনুর চেয়েও ভালো”- প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশকে এক চিঠিতে একথা লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯০৮ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় অমিয়া দেবীর জন্ম। তাঁর বাবা সুরেন্দ্রনাথ রায় ছিলেন সঙ্গীতরসিক। তাঁরই আগ্রহে অমিয়ার গান শেখার শুরু।
ঈশ্বরদত্ত সুরেলা ও সুমধুর কন্ঠে যুক্ত হয়েছিল উপযুক্ত তালিম। যে তালিমের শুরু এক ওস্তাদের কাছে হলেও পরে তিনি ধ্রুপদিয়া গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে দীর্ঘ তালিম নিয়েছিলেন। অমিয়া দেবীর মাসি সত্যবালা দেশাই সেই ১৯১০ সালেই বিলেতে বীণা ও বেহালা বাজানোর অনুষ্ঠান করেছিলেন। সেই বছরে সত্যবালার যে রেকর্ড প্রকাশিত হয় তাতে সত্যবালা গানও গেয়েছিলেন। এই সত্যবালার কাছেও গান শিখেছিলেন অমিয়া।
বেথুনের ছাত্রী থাকাকালীন হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কন্যা মনীষা দেবী অমিয়াকে নিয়ে আসেন সরলা দেবীর কাছে। ‘মায়ার খেলা’-র অভিনয়ের জন্য সরলা দেবী তখন নায়িকার সন্ধান করছিলেন। অমিয়া ছিলেন যেমন সুন্দরী তেমনই গুণী। অভিনয়ের অভিজ্ঞতাও ছিল তাঁর। স্কুলে পড়তেই ‘চন্দ্রগুপ্ত’, 'নূরজাহান' ইত্যাদি নাটকে তিনি নায়িকা চরিত্রে অভিনয় করেছেন। সরলা দেবীর কাছে প্রমদার গান তুলে নিলেন অমিয়া। এর পর এল নাচের পালা। সরলা দেবীই নিয়ে গেলেন রবীন্দ্রনাথের কাছে। রবীন্দ্রনাথ নিজে তাঁকে দেখিয়ে দিলেন প্রমদার নৃত্যভঙ্গিমা।
অনেক দিন মহড়া দিয়ে 'রক্সি’ সিনেমা হলে হল 'মায়ার খেলা’-র অভিনয়। অনবদ্য সেই অভিনয়ে শান্তার ভূমিকায় ছিলেন রুমা গুহঠাকুরতার মা সতী দেবী। সাজপোশাক করিয়ে দিয়েছিলেন প্রতিমা দেবী, পারুল দেবী আর সুজাতা দেবী। প্রমদার ভূমিকায় সবাইকে মুগ্ধ করেছিলেন অমিয়া। এ প্রসঙ্গে ইন্দিরা দেবী বলেছেন, “সরলাদিদি সম্পাদিত 'ভারতী’-র সাহায্যার্থে রবিকাকার নির্দেশে জোড়াসাঁকোর বাড়ির লোকেরা অভিনয় করে টাকা তুলে দেন। তার মধ্যে অমিয়া বউমা প্রমদা সেজে খুব সুন্দর অভিনয় ও গান করেন।”
এই অভিনয়ের পরেই রবীন্দ্রনাথের সেজদাদা হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পৌত্র হৃদীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে অমিয়া দেবীর বিয়ে হল। বিয়ের পর অমিয়া গান শিখতে শুরু করলেন দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং ইন্দিরা দেবীর কাছে। গান শেখা বজায় থাকলেও স্বামীর উৎসাহ না থাকায় গানের অনুষ্ঠান করা তাঁর খুব একটা হয়নি।
১৯৩১ সালে রবীন্দ্রনাথের ৭০ বৎসর পূর্তি অনুষ্ঠান হয়েছিল ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটে। এই উপলক্ষে অমিয়া দেবী প্রকাশ্যে গান গাইলেন। প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের ভাই প্রফুল্লচন্দ্র মহলানবিশের স্মৃতিতে উজ্জ্বল ছিল সেই অনুষ্ঠান – “১৯৩১ সালে কবির ৭০ বছর পূর্ণ হওয়ায় কলকাতা শহরে বিরাট রবীন্দ্রজয়ন্তী উৎসব সম্পন্ন হয়। সেই উপলক্ষে ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটে ৩/৪ দিন ধরে গানের জলসা বসে এবং তখন শহরের নতুন পুরোনো সব রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইয়েরা এসে জড়ো হলেন।
এই জলসার একটি অধিবেশনে অমিয়া ঠাকুরের গাওয়া 'মরি লো মরি আমায় বাঁশিতে ডেকেছে কে’ এই গানের কথা বোধহয় অনেকে আজও ভোলে নি। অমিয়ার গান শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথও। তাঁরই আগ্রহে দ্বিতীয় দিন অমিয়া আবার গাইলেন ‘ওগো কাঙাল আমারে কাঙাল করেছ’। তাঁর গানের সঙ্গে এসরাজ বাজিয়েছিলেন দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে অমিয়ার দখল ছিল গভীর। তাঁর গলায় সেই সব গান শুনতে ভালোবাসতেন রবীন্দ্রনাথ। অমিয়া দেবী জানিয়েছেন, “আমার গলায় শুনে একটি হিন্দী গান ভেঙে বাংলা গান তৈরী আমার জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় স্মৃতি”। অমিয়ার গাওয়া ‘এ ধ্বনি চরণ পরসত’ এই খেয়াল শুনে রবীন্দ্রনাথ তৈরি করেছিলেন ‘কী ধ্বনি বাজে গহন চেতনা মাঝে’।
শৈলজারঞ্জন মজুমদারের তত্ত্বাবধানে একটি রেকর্ডও করেছিলেন অমিয়া। ‘হে নূতন দেখা দিক আর বার’ ও 'সমুখে শান্তিপারাবার’ এই দুটি গান ছিল সেই রেকর্ডে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রছাত্রী উৎসব পরিষৎ-এর পক্ষ থেকে যে অনুষ্ঠান হয়েছিল তাতে রবীন্দ্রনাথের নির্দেশ অনুসারে অমিয়া গেয়েছিলেন ‘সখি আঁধারে একেলা ঘরে'।
‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ চলচ্চিত্রে অমিয়া দেবীকে খালি গলায় 'এ পরবাসে রবে কে’ গাইতে অনুরোধ করেছিলেন সত্যজিৎ রায়। অমিয়া দেবীর সেই গানে আজকের দর্শক-শ্রোতাও মুগ্ধ হয়। এখানেই তাঁর গানের অনন্যতা। অনায়াসে তা সময়কে অতিক্রম করে যায়। গান গেয়ে পুরষ্কার তিনি অনেক পেয়েছিলেন। ১৯৭৬ সালেও কালিদাস নাগ মেমোরিয়াল
কমিটি তাঁকে পদক দিয়ে সম্মান জানিয়েছিল। ‘পঞ্চকন্যা'-র গান নামের রেকর্ডেও তিনি গেয়েছেন ‘বড় বিস্ময় লাগে’ ও ‘তবু মনে রেখো'-র মতো গান। বয়েস তাঁর কন্ঠকে সুরহীন, মাধুর্যহীন করেনি কখনও। যদিও অমিয়া দেবী মনে করতেন, তাঁর গানে অতীতের গায়কী আছে বলেই লোকে তাঁর গান শুনতে চায়। এই প্রসঙ্গে দেবব্রত বিশ্বাস বলেছিলেন- ‘অমিয়া ঠাকুর বোধহয় তাঁর ৭০ বৎসর পার করে ফেলেছেন। এখনও তাঁর গলায় যা স্বাভাবিক কাজ বেরোয় তা স্বরলিপি করা তো দূরের কথা, বর্তমান কালের অথরিটিরা কেউ তা নিজের গলায় গেয়ে দেখাতে পারবেন না’।
এমনই ছিলেন অমিয়া দেবী। সুরসম্রাজ্ঞী। ইন্দিরা দেবী বলেছিলেন, ‘আমার সেজকাকাও খুব নিষ্ঠাবান শিক্ষাব্রতী ছিলেন। তাঁর ঘরে দিশি বিলিতি সঙ্গীতের যুগল স্রোত অবিরাম বয়ে চলেছিল’। সেই ধারার সার্থক উত্তরাধিকারী ছিলেন অমিয়া দেবী। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে তাঁর কন্ঠকে অভিজ্ঞা দেবীর কন্ঠের সঙ্গে তুলনা করেছেন অনেক প্রাচীনাই। ১৯৮৬ সালে অমিয়া দেবীর প্রয়াণের সঙ্গেই অবসান হল সেই অসামান্য গায়কীর।
In English

